• বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ০৪:১১ পূর্বাহ্ন

খালেদা জিয়ার নির্বাচন করা নিয়ে অস্পষ্টতা আইন ও সংবিধানের ব্যাখ্যার পাশাপাশি কিছু দৃষ্টান্তও সামনে রয়েছে

আপডেটঃ : শনিবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ে বিচারিক আদালত বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গণে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি এখন সামনে এসেছে সেটি হলো- খালেদা জিয়া কি আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন? প্রচলিত আইন, সংবিধান এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উচ্চ আদালতের কিছু তরতাজা রায় ও পর্যবেক্ষণ গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে সরাসরি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ গোছের উত্তর মেলে না। যার সারমর্ম হচ্ছে- বিষয়টি আসলে অস্পষ্ট।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের মাত্র ৯-১০ মাস আগে খালেদা জিয়ার এই দণ্ড হওয়ায় সাধারণ্যেও ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা চলছে যে, কারাবন্দি বিএনপি প্রধান কি নির্বাচন করতে পারবেন? এনিয়ে জনমনে কৌতুহলেরও অন্ত নেই। সংশ্লিষ্টরা আইন ও সংবিধানের আলোকে মোটাদাগে বলছেন, হাইকোর্ট যদি খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত বা বাতিল করেন তাহলে তিনি নির্বাচন করতে পারবেন। হাইকোর্ট যদি দণ্ড স্থগিত না করেন এবং সেক্ষেত্রে জামিনে মুক্তি পেলেও তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। আবার হাইকোর্ট যদি দণ্ড স্থগিত বা বাতিল করেন এবং পরবর্তীতে যদি আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করে বিচারিক আদালতের রায় বহাল রেখে দেন তাহলেও খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। এসবই আইন ও সংবিধানের মোটাদাগের ব্যাখা। তবে এর বাইরেও কথা আছে, বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা যখন উচ্চ আদালতে যাবেন তখন আইন ও সংবিধানের পাশাপাশি কিছু দৃষ্টান্তও তারা সামনে নিয়ে আসবেন।
দুর্নীতির দায়ে বৃহস্পতিবার খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হওয়ার পরপরই আগামী নির্বাচনে তার অংশগ্রহণের যোগ্যতা-অযোগ্যতা প্রশ্নে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এক্ষেত্রে দুটি রায় আছে। আপিল চূড়ান্ত পর্যায়ে না যাওয়া পর্যন্ত একটি রায় বলছে নির্বাচনে অংশ নেয়া যাবে, অন্য রায় বলছে যাবে না। এখন ওনার (খালেদা জিয়া) ব্যাপারে আপিল বিভাগ এবং স্বাধীন নির্বাচন কমিশন কী সিদ্ধান্ত নেবে, সেটা তাদের বিষয়।’ ১৯৯৬ সালে আপিল বিভাগের একটি রায়ে বিচারপতি মোস্তফা কামাল বলেছিলেন, এ ধরনের অযোগ্যতার প্রশ্ন ঠিক হবে ভোটের পরে, নির্বাচনী ট্রাইবুন্যালে। রিটার্নিং অফিসার মনোনয়ন বাতিল করলেও রিট চলবে না। অন্য রায়টি দিয়েছিল হাইকোর্ট। হাইকোর্ট রায়ে বলেছিল, বিচারিক আদালতে কেউ দ্লিত হওয়ামাত্রই নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। তার দোষী সাব্যস্ত হওয়ার (দণ্ড) বিষয়টি স্থগিত করার ক্ষমতা আপিল আদালতের হাতে নেই।
সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিষয়ে সংবিধানের ৬৬ (২ গ) অনুচ্ছেদে বলা আছে, নৈতিক স্খলনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ন্যূনতম দুই বছর কারাবাসে থেকে মুক্তির পর পাঁচ বছর পার না হলে কেউ নির্বাচনে যোগ্য হবেন না।
খালেদা জিয়ার মামলার বিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহ্দীন মালিক ইত্তেফাককে বলেন, ‘নিম্ন আদালতে সাজা হলেই কেউ নির্বাচন করতে পারবেন  কি-না, বিষয়টি আসলে আমাদের আইনে স্পষ্ট নয়। নিম্ন আদালতে খালেদা জিয়ার সাজা হয়েছে, এখন তিনি উচ্চ আদালতে আপিল করবেন, এটা স্বাভাবিক। উচ্চ আদালত যদি নিম্ন আদালতের রায়ের উপর স্থগিতাদেশ না দেয় এবং আপিল বিচারাধীন থাকলে আইনের স্বাভাবিক হিসাব বলে-কারাগারে থেকেও তিনি নির্বাচন করতে পারবেন। আর উচ্চ আদালত যদি তার আপিল খারিজ করেন তাহলে অন্য কথা। তাছাড়া উচ্চ আদালতের ইদানিং কিছু রায়ে বিষয়গুলো নিয়ে অস্পষ্টতা দেখা দিয়েছে। যেমন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার সাজা হয়েছিল, হাইকোর্ট তার আপিল খারিজ করে দেয়, এরপর আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ খারিজ করে নতুন করে শুনানির নির্দেশ দেয়। এর অর্থ হচ্ছে মামলাটি এখনো হাইকোর্টে বিচারাধীন। কিন্তু মায়ার মন্ত্রিত্ব কিংবা সংসদ সদস্য পদ তো যায়নি। আপিল করা অবস্থায় তিনি সংসদ সদস্য পদে বহাল আছেন। কাজেই এখানে মন্ত্রী মায়ার বিষয়টি একটি উদাহরণ হয়ে থাকছে। এই উদাহরণ ধরে এটা বলা যায়, উচ্চ আদালতে আপিল থাকলে কেউ নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ার কথা নয়।’
শাহ্দীন মালিক বলেন, ‘নবম সংসদের সদস্য থাকা এবং যিনি বর্তমান সংসদেরও সদস্য ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মামলার রায় ও এর ঘটনাপ্রবাহও আমাদের সামনে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। কক্সবাজার-৪ আসনের এমপি (আওয়ামী লীগের) আবদুর রহমান বদির তিন বছর সাজা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে আপিল চলমান, বাস্তবতা হচ্ছে তিনিও এমপি পদে বহাল আছেন। কাজেই নিম্ন আদালতে সাজা হলেই কোনো ব্যক্তি নির্বাচন করতে পারবেন না-বিষয়টি চূড়ান্ত নয় বলেই ধরে নেয়া যায়।’
বিশিষ্ট এই সংবিধান বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, “নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্যতা-অযোগ্যতা সম্পর্কে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদেও ‘হইবার’, ‘থাকিবার’ ইত্যাদি কথা বলা আছে। এখন কথা হলো সরকারি দলের এমপি-মন্ত্রীদের স্বপদে বহাল থাকার যেসব উদাহরণ সবার সামনে আছে, স্বাভাবিক হিসাবে সেই সুযোগ খালেদা জিয়ারও থাকার কথা। কিন্তু এরপরও কথা থেকে যায়।’
আইনজ্ঞদের মতে, আইন ও সংবিধানের গভীর পর্যালোচনা বলে- ফৌজদারি অপরাধে চূড়ান্ত সাজা না হওয়া পর্যন্ত আইনের দৃষ্টিতে কাউকে দোষী বলে গণ্য করা যায় না। আমাদের দেশে সাজা চূড়ান্ত করার একমাত্র এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের। নিম্ন আদালত বা হাইকোর্টে সাজার উপর নির্ভর করে অতীতে কারো সংসদ সদস্য পদ খারিজ হয়নি বা নির্বাচনের অযোগ্যতাও সৃষ্টি হয়নি। তবে নিম্ন আদালত বা হাইকোর্টে দ্লের বিরুদ্ধে কারো আপিল গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত ওই ব্যক্তির দণ্ডাদেশ বহাল থেকে যায়। কিন্তু আপিল গৃহীত হলে তাকে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি বলা হয় না। তিনি গণ্য হন বিচারাধীন ব্যক্তি হিসেবে।
আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, দেশ স্বাধীনের পর এখন পর্যন্ত বিচারাধীন দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অযোগ্যতার কোন উদাহরণ সৃষ্টি হয়নি। এমনকি পদে বহাল না থাকারও কোন নজির নেই। বরং জেনারেল এরশাদসহ অসংখ্য দণ্ডপ্রাপ্ত বিচারাধীন ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিতে  পেরেছেন এবং সংসদ সদস্য পদেও বহাল থেকেছেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে নিম্ন আদালতের দেয়া ১৩ বছরের সাজা বাতিল সংক্রান্ত হাইকোর্টের আদেশ ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে আপিল বিভাগ বাতিল করে দেয়। আপিল বিভাগের ওই রায়ের প্রসঙ্গে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম খান তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আপিল বিভাগের এই রায়ের পর ধরে নিতে হবে নিম্ন আদালতের সাজার বিরুদ্ধে মায়ার আপিল হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। সে কারণে তার জামিন বহাল এবং সাজা স্থগিত থাকবে।’ দুদকের প্রধান আইনজীবীর বক্তব্য অনুযায়ী মায়ার সাজা স্থগিত রয়েছে। ফলে তিনি আইনের দৃষ্টিতে অযোগ্য হয়ে পড়েছেন এ কথা বলা যায় না।
সংবিধানের ৬৬ (২) ঘ অনুচ্ছেদ ধরে এগোলে দেখা যায়, মন্ত্রী মায়া এখনো দণ্ডভোগ করেননি। এছাড়া তার নিম্ন আদালতের দণ্ড স্থগিত রয়েছে। এ ধরনের একটি সাংবিধানিক প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছিল এইচএম এরশাদকে সাজা  দেয়াকে কেন্দ্র করে। ১৯৯০ সালে কারাগারে যাওয়ার পর এরশাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার মধ্যে ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত জনতা টাওয়ার দুর্নীতি মামলা, রাষ্টপ্রধান হিসেবে পাওয়া উপহার সামগ্রী আত্মসাত্সংক্রান্ত দুর্নীতির মামলাসহ তিনটি মামলায় নিম্ন আদালতে এরশাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। এসব মামলায় এরশাদের ৩ থেকে ১৩ বছরের দণ্ড দিয়েছিল নিম্ন আদালত। এর বিরুদ্ধে এরশাদ হাইকোর্টে আপিল করেন। নিম্ন আদালতের সাজার সময় এরশাদ সংসদ সদস্য ছিলেন। কিন্তু তার আপিল বিচারাধীন থাকার কারণে সংসদ সদস্যপদ বাতিলের প্রশ্ন সেসময় উত্থাপিত হয়নি। কিন্তু জনতা টাওয়ার মামলায় ২০০০ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এরশাদের সাজা চূড়ান্ত করে। যে কারণে এরশাদ ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। এমনকি তার সংসদ সদস্য পদও খারিজ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নিম্ন আদালতের সাজার পর হাইকোর্টে আপিল করে এরশাদ ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পেরেছিলেন। এই ইস্যুটি ১৯৯৬ সালেই উচ্চ আদালত নিষ্পত্তি করে। সেসময় এরশাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কুড়িগ্রাম আসনে বিএনপি দলীয় প্রার্থী হাইকোর্টে একটি রিট মামলা দায়ের করেছিলেন। কিন্তু হাইকোর্ট এরশাদকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকার প্রশ্নে কোন আদেশ দেয়নি।
খালেদা জিয়ার রায়কে ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতি সম্পর্কে তার আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমরা উচ্চ আদালতে খালেদা জিয়ার জামিন চাইবো। আর নির্বাচনে অংশ নিতে পারা না পারার বিষয়ে উচ্চ আদালতের রায়গুলোতেই কিছু অস্পষ্টতা আছে। আমরা সবদিক সামনে রেখেই প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
এদিকে, ২০১৭ সালের ৯ মে মো. মামুন বনাম রাষ্ট্র মামলায় বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি মো. খুরশিদ আলম সরকার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ ‘দোষী সাব্যস্ত’, ‘দণ্ড স্থগিত’ এবং ‘দ্ল কার্যকরণ স্থগিত’ হওয়ার মধ্যে প্রভেদ সুনির্দিষ্ট করে একটি রায় দেয়। তাতে স্থির করা দিকনির্দেশনায় বলা হয়, ‘নিম্ন আপিলাত আদালত’-এর এখতিয়ার কেবল দ্ল স্থগিত করার। দোষী সাব্যস্ত হওয়ার কার্যকারিতা স্থগিত করার ক্ষমতা তার নেই। মামলাটির অন্যতম অ্যামিকাস কিউরি প্রবীর নিয়োগী এ মত দিয়েছিলেন। সামগ্রিক বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে বলা যায়, একাদশ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণ করতে পারা না পারার বিষয়টি কার্যত অস্পষ্ট।
এদিকে, এখনই কঠোর কোনো আন্দোলনের কর্মসূচির দিকে যাচ্ছে না বিএনপি। খালেদা জিয়ার দ্লের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাওয়ার পর এর ফলাফল এবং সরকারের ভূমিকা দেখে দলটি পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, কারাগারে যাওয়ার আগে খালেদা জিয়া তাদের স্পষ্ট বলে গেছেন যেন নিয়মতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হয়। কোনো ধরনের হটকারী সিদ্ধান্ত না নিতে বিএনপি প্রধান শেষ মুহূর্তেও দলের নেতাদের সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে গেছেন বলে জানান ফখরুল।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ