নিয়মকানুন না মেনে নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার কারণে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। আর এসব ঋণ আদায়ও হচ্ছে না। ফলে ওইসব খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশনও রাখতে হচ্ছে। তাতে মূলধন ঘাটতিতে পড়ছে ব্যাংক। ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া কোন উদ্যোগই কাজে আসছে না।
মূলধন ঘাটতি সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ। ফলে শুধু ব্যাংকিং খাতে নয়, পুরো অর্থনীতিতেই বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা থাকে। বিদেশি বিনিয়োগেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে ঘাটতির মুখে পড়া ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বিদেশি ব্যাংকগুলো লেনদেন করতে আস্থার সঙ্কট দেখা দেয়। এতে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে গ্যারান্টি হিসেবে তাদের বাড়তি ফি দিতে হয়, যার প্রভাবে ব্যবসা ব্যয় বেড়ে যায়।
বাজেট থেকে বারবার অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হলেও মূলধন ঘাটতি বেড়েই চলেছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর। গত চার বছরে বাজেট থেকে ৯ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর পরও চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঘাটতি হয় প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর মধ্যে ফারমার্স ব্যাংক প্রথম মূলধন ঘাটতি পড়েছে।
বছরের পর বছর ধরে ঘুরেফিরে সরকারি ব্যাংকগুলোতে মূলধন ঘাটতি থাকছে। এসব ব্যাংকে জনগণের করের টাকায় বারবার মূলধন জোগান দেওয়ায় বিভিন্ন মহলে সমালোচনা রয়েছে। সমপ্রতি রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলোর বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক সেমিনারে এসব ব্যাংকের সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত না করে বারবার মূলধন জোগান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বক্তারা। তবে এখন বেসরকারী ব্যাংকও মূলধন ঘাটতিতে পড়ছে।
নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংক সেপ্টেম্বরে এসে প্রায় ৭৫ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়ে। গত জুনে ব্যাংকটির ৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকার মূলধন উদ্বৃত্ত ছিল। এ ব্যাংকের সঙ্কট মেটাতে এক সপ্তাহের মধ্যে এর পরিচালকদের অন্তত ২০০ কোটি টাকা জোগান দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বেসরকারি আইসিবি ইসলামী ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক দীর্ঘ দিন ধরে মূলধন ঘাটতি নিয়ে চলছে। তিন মাসে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ঘাটতি এক হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে এক হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ঘাটতি ৩১৩ কোটি টাকা থেকে কমে ২৩১ কোটি টাকা হয়েছে।
ব্যাংকগুলোর সম্পদ (ঋণ) বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বাড়ে। ঋণের মান অনুযায়ী ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ নির্ণয় করা হয়। যে ব্যাংকের গুণগত মানসম্পন্ন ঋণ বেশি তার ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ কম। খারাপ ঋণের কারণে ব্যাংকগুলো যেন পরিচালনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের সংকটে না পড়ে এ জন্য আন্তর্জাতিক নিয়মানুসারে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। যে ব্যাংকের মূলধন যত কম তার সঙ্কট মোকাবিলার সামর্থ্যও তত কম। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ব্যাসেল-৩ অনুসারে মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। পাশাপাশি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কোনো ঝুঁকির ফলে সম্ভাব্য ক্ষতি মোকাবিলায় আরও ১ দশমিক ২৫ শতাংশ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সরকারি ব্যাংকগুলোর গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঘাটতি রয়েছে ১৫ হাজার ৯০৮ কোটি। সবচেয়ে বেশি মূলধন ঘাটতি রয়েছে সোনালী ব্যাংকের ৩ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। বেসিক ব্যাংকের ঘাটতি ২ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। এছাড়া জনতা ব্যাংকের ঘাটতি এক হাজার ২৭৩ কোটি ও রূপালী ব্যাংকের ঘাটতি ৬৯০ কোটি টাকা। সরকার মালিকানাধীন বিশেষায়িত খাতের কৃষি ব্যাংকের ঘাটতি ৭ হাজার ৫৪০ কোটি এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) ঘাটতি ৭৪২ কোটি। সরকারি মালিকানাধীন বিশেষায়িত ও বাণিজ্যক ৮ ব্যাংকের মধ্যে ৬ ব্যাংকেরই মূলধন ঘাটতি হয়েছে। এ ৬ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১৫ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা।