নিরাপদ কেনাকাটা কিংবা কোনো বিল পরিশোধ করতে ক্রেডিট কার্ডের জুড়ি নেই। নগদ টাকার বিকল্প হিসাবে ক্রেডিট কার্ডের সুবিধাও অনেক। নানান সুবিধা বিবেচনা করে গ্রাহকরা ক্রেডিট কার্ড নেন। তারপরও নানা কারণে সুবিধার চেয়ে অসুবিধা বেশি বলেই এখন ব্যবহারকারীরা মনে করছেন। অনেকের কাছে এটি এখন আতঙ্কের বিষয়। একসময় কাবুলিওয়ালাদের ব্যবসার মতো হালের ক্রেডিট কার্ডের ব্যবসা চলছে বলে মন্তব্য করেছেন অনেকেই। চটকদার বিজ্ঞাপনে গ্রাহকরা বছরের পর বছর চরম প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। প্রায় প্রত্যেক ক্রেডিট কার্ডধারীরই এ বিষয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ সব কারণে বাংলাদেশে ক্রেডিট কার্ড জনপ্রিয় হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা না মেনে ব্যাংকগুলো তাদের ইচ্ছা মাফিক সুদ ও অন্যান্য ফি আদায় করায় এমন ঘটছে।
ব্যাংক ও ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহারকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুদের হারই ক্রেডিট কার্ডের একমাত্র ব্যয় নয়। সময়মতো মাসিক মূল্য পরিশোধ না করলে জরিমানা গুনতে হয়। এ জন্য ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার বেশ বিপজ্জনক হয়ে ওঠে সময়জ্ঞান না থাকলে। ক্রেডিট কার্ড দিয়ে নগদ টাকা তুললে গুনতে হয় বাড়তি ফি।
ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারী জানিয়েছেন, ব্যাংকের মার্কেটিং প্রতিনিধিদের অনুরোধ ও তাদের মিষ্টভাষী প্রচারণায় ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক হবার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। ব্যাংকগুলোর মার্কেটিং পলিসির কাছে হেরে গিয়ে কার্ড নিয়েছেন অনেক গ্রাহক। ব্যাংক তাদের সঙ্গে ‘শর্ত প্রযোজ্য’ দিয়ে ভয়াবহ প্রতারণা করছে। ব্যাংকগুলো ১৬ থেকে ৩৬ শতাংশ হারে সুদ নেওয়ার কথা বললেও বাস্তবে নিচ্ছে ৩০ থেকে ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত। আর তাদের এ প্রতারণা থেকে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যাংকার, জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা কেউই বাদ পড়ছেন না। এদের মধ্যে যারা একটু সচেতন, তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হচ্ছেন। বাকিরা এ ক্রেডিট কার্ডের ফাঁদে অর্থদণ্ড দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
একজন ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারী জানিয়েছেন, একবার ০৫ পয়সা বিল কম দেওয়ার জন্য ৫০০ টাকা জরিমানা গুনতে হয়েছিল। কারণ ওই ব্যাংকের জরিমানা আদায়ের ন্যূনতম পরিমাণ ছিল ৫০০ টাকা।
ক্রেডিট কার্ডে ব্যয় করা টাকা আদায়ের ক্ষেত্রে সাধারণত থার্ড পার্টি নিয়োগ করে থাকে ব্যাংকগুলো। ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কার্ডের ক্ষেত্রে যে সুদ ঘোষণা করা হয় বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি হয়। কারণ, ব্যাংকাররা সব সময় বলে থাকেন যে ক্রেডিট কার্ডে আরোপিত সুদের হার হলো আড়াই থেকে তিন শতাংশ। কিন্তু এই সুদের হার যে মাসিক, এটা বলা হয় না। সাধারণত, সকল সুদের হার বাত্সরিক হিসাব করা হলেও ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার মাসিক হিসাব করে অনেক ব্যাংক। এতে প্রতি মাসেই এ ঋণ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে। এ ছাড়া কোনো গ্রাহক যদি নির্ধারিত সময়ের ভেতর বিলের ৯০ শতাংশ টাকা পরিশোধ করে দেন, তবু পরের মাসে পুরো টাকার ওপর পুরো মাসের জন্য সুদ আরোপ করা হবে। এ ছাড়া সার্ভিস চার্জ, নবায়ন ফি, পেনাল্টি চার্জগুলো তো রয়েছেই। পেনাল্টির ক্ষেত্রে বেশিরভাগই ঘটে গ্রাহকের অজ্ঞতার কারণে। আর ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে ইচ্ছা করেই গ্রাহককে এসব বিষয়ে সচেতন করা হয় না।
ক্রেডিট কার্ডে সুদের হার কত হবে সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছরের মে মাসে একটি নীতিমালা দেয়। নীতিমালা অনুযায়ী কোনো ব্যাংক সুদে ভোক্তা ঋণ দেয়, তাদের ক্রেডিট কার্ডে সুদের হার তার চেয়ে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ বেশি হতে পারবে। তবে বাস্তবে তেমনটা দেখা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কার্ডের সুদহার নির্ধারণ করছে। তবে কিছু ব্যাংক হয়ত এ নিয়মের বাইরে আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেখা গেছে, ভোক্তা ঋণের চেয়ে প্রায় সবগুলো ব্যাংকেরই ক্রেডিট কার্ডের ঋণে সুদের হারের ব্যবধান ৫ শতাংশীয় পয়েন্টের বেশি। জানুয়ারি মাস শেষের হিসাবে দেখা গেছে, জনতা ব্যাংকের ভোক্তা ঋণে সুদের হার ১১ থেকে ১২ শতাংশ। অথচ ক্রেডিট কার্ডে সুদের হার ২৪ শতাংশ। একইভাবে ব্যাংক এশিয়ার ক্রেডিট কার্ডে যেখানে সুদের হার ৩০ শতাংশ, সেখানে ভোক্তা ঋণে সুদের হার ৯ থেকে ১২ শতাংশ। ব্র্যাক ব্যাংকে ভোক্তা ঋণে সুদের হার ১০ থেকে ১৩ শতাংশ আর ক্রেডিট কার্ডে সুদের হার ৩৩ থেকে ৩৬ শতাংশ। ঢাকা ব্যাংকে ক্রেডিট কার্ডে সুদের হার ২৪ শতাংশ আর ভোক্তা ঋণে সুদ ১০ থেকে ১৩ শতাংশ। এভাবে ইস্টার্ন, এক্সিম, মিডল্যান্ড, মার্কেন্টাইল, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, এনসিসি, স্টান্ডার্ড, ট্রাস্ট এবং প্রাইম ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডে সুদের হার ৩০ শতাংশ। ওয়ান ব্যাংকে ক্রেডিট কার্ডে সুদের হার সাড়ে ২৮ থেকে সাড়ে ৩১, মধুমতি ও ন্যাশনাল ব্যাংকের ২৭ শতাংশ, এনআরবি ব্যাংকে ২৫, আইএফআইসি, যমুনা, মেঘনা, প্রিমিয়ার, শাহজালাল ইসলামী ও সাউথইস্ট ব্যাংকে ক্রেডিট কার্ডের সুদ ২৪, এনআরবি কমার্সিয়ালে সুদ ১৬ থেকে ৩০, দ্য সিটিতে এবং ইউনিয়ন ব্যাংকে ২৫ শতাংশ। যা এসব ব্যাংকের ভোক্তা ঋণের সুদের হারের চেয়ে অনেক বেশি। এর বাইরে বিদেশি ব্যাংকগুলোতেও ক্রেডিট কার্ডে সুদের হার ভোক্তা ঋণের চেয়ে বেশি। বিদেশি মালিকানার ব্যাংকগুলোর মধ্যে তিনটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড রয়েছে। এর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডে সুদের হার ২২ থেকে ২৫ শতাংশ আর কমার্সিয়াল ব্যাংক অব সিলনের ২১ থেকে ২৪ শতাংশ।
ক্রেডিট কার্ড নিয়ে হয়রানি থেকে বাদ পড়ে না কেউই। বাংলাদেশ পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ক্রেডিট কার্ড নিয়ে বিড়ম্বনার বিষয়ে সম্প্রতি ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা অসুবিধা নিয়ে আলোচনা করেছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। ওই পোস্টের একটি কমেন্টসে বলা হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই ক্রেডিট কার্ড নিতে না চাইলেও জোর করে দেওয়া হয়। ওই পুলিশ কর্মকর্তা লিখেছেন ‘আমি ক্রেডিট কার্ড বিষয়টা একদম পছন্দ করি না। ক্রেডিট কার্ড লাগবে না বললেও তিনটি ব্যাংক জোর করে গছিয়ে দিয়ে গেছে। ক্রেডিট কার্ডের টাকা নেওয়ার জন্য যারা ফোন দেয় তাদের আচরণে তো মনে হয় আমি একজন দিনমজুর।’