বছর শেষে ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ আয় করছে নিট বা প্রকৃত মুনাফার হিসাবে তা কমে যাচ্ছে। ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা থেকে কর, প্রভিশনসহ অনেক কিছু বাদ দিয়ে প্রকৃত মুনাফা হিসাব করা হয়। তবে পরিচালন মুনাফার চেয়ে বেশি পরিমাণ প্রভিশন রাখতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোর। বছর শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো ব্যাংকগুলোর অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে ব্যাংকগুলো ২৪ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফা করেছে। আগের বছর যা ছিল ২১ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা। এতে করে এক বছরের ব্যবধানে পরিচালন মুনাফা বেড়েছে তিন হাজার ৭৯ কোটি টাকা। আর এক বছরের ব্যবধানে নিট মুনাফা বেড়েছে মাত্র ৯৮৯ কোটি টাকা। সে হিসাবে গেল বছরে নিট মুনাফার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। মূলত, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা আগের তুলনায় বেড়ে গেছে। ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে ২০১৭ সাল শেষে ব্যাংকগুলোর ৪৪ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা প্রভিশন রাখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। আগের বছর রাখতে হয়েছিল ৩৬ হাজার ২০৯ কোটি টাকা। এতে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে ৮ হাজার ৮৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ঋণ শ্রেনীকরণের (খেলাপি) তিনটি পর্যায় রয়েছে। তা হলো নিম্নমান, সন্দেহজনক এবং মন্দ বা ক্ষতি। এই তিনটি পর্যায় বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকগুলোকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে হয়। ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ নিম্নমানের ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ প্রভিশন, ৬ থেকে ৯ মাসের মধ্যে হলে সন্দেহজনক ঋণ, যার বিপরীতে ৫০ শতাংশ প্রভিশন এবং ৯ মাসের বেশি হলে তাকে মন্দ বা ক্ষতি মানে বিবেচিত হয়, এর বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। এ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে। খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে, আর সে অনুযায়ী ব্যাংকের আয় না হলে প্রভিশন ঘাটতি দেখা দেয়। অর্থাত্ ব্যাংকটি যে পরিমাণ আয় করে তা দিয়ে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে না পারায় ঘাটতি দেখা দেয়। প্রভিশন ঘাটতি হলে ওই ব্যাংকের রিটেইন আর্নিং কমে যায়। এভাবে পরবর্তী সময় সমন্বয় করতে না পারলে মূলধন ঘাটতি দেখা দেয়। আর সেই সাথে ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি আয়ও (ইপিএস) কমে যায়। আয় কমে গেলে সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হন।
বাংলাদেশ ব্যাংকে তফসীলি ব্যাংকগুলোর পাঠানো প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো ২০১৭ সালে ১৮ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফা করেছে। এর বিপরীতে নিট মুনাফা হয়েছে ৭ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। আগের বছর এসব ব্যাংক ১৭ হাজার ৫২১ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফার বিপরীতে নিট মুনাফা করেছিল ৭ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা। বেসরকারি ৪০টি ব্যাংকের মধ্যে ২৩টি ব্যাংকের মুনাফা বেড়েছে।
অন্যদিকে মুনাফা কমেছে ১৭টি ব্যাংকের। অনিয়মের কারণে আলোচিত ফারমার্স ব্যাংক ২০১৭ সালে ৫৪ কোটি টাকার নিট লোকসান দিয়েছে। আগের বছর ব্যাংকটি ২৪ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের নিট লোকসান হয়েছে ৪১ কোটি টাকা। রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলো আগের বছরের চেয়ে ভালো মুনাফা করেছে। সরকারি ৬ বাণিজিক ব্যাংক এক হাজার ৭৫৮ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফার বিপরীতে নিট মুনাফা করেছে ৭১৬ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে ২ হাজার ১১ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফার বিপরীতে নিট লোকসান ছিল ৫১১ কোটি টাকা। বিশেষায়িত দুই কৃষি ব্যাংক ৬৫১ কোটি টাকার পরিচালন লোকসানের বিপরীতে নিট লোকসান দিয়েছে ৫৫৪ কোটি টাকা। আগের বছর ব্যাংক দুটি ৪১৯ কোটি টাকা লোকসান করেছিল। এছাড়া বিদেশি মালিকানার ৯ ব্যাংক ২ হাজার ৩৯০ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফার বিপরীতে নিট মুনাফা করেছে এক হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। আগের বছর এসব ব্যাংকের ২ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফার বিপরীতে এক হাজার ৪৩০ কোটি টাকা নিট মুনাফা হয়েছিল। বিদেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ৩১ কোটি টাকার নিট লোকসান করেছে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান।
ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূরুল আমিন বলেন, বর্তমানে ব্যাংকের কার্যক্রম অনেক বেড়েছে। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কাজ ব্যাংকের মাধ্যমে হচ্ছে। ফলে ব্যাংকের ব্যবসা থেমে নেই। তবে ব্যাংক খাতে খেলাপিও বেড়েছে। এতে প্রভিশন রাখতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর বড় অংকের টাকা চলে গেছে।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংকের গুণগত পরিবর্তন না হলে তা মুনাফার ক্ষেত্রে ভাল ভূমিকা রাখতে পারবে না। আগ্রাসী বিনিয়োগ হলে অনেক ক্ষেত্রে পরিচালন মুনাফা বাড়ে। তখন আপাতদৃষ্টিতে নিট মুনাফা বাড়লেও পরবর্তীতে তা সমস্যা তৈরি করতে পারে।