১৯২৬ সালের ১ জানুয়ারি, আবদুল ওয়াহিদ নোয়াখালি জেলার রামগঞ্জের ভাদুর গ্রামের কাজি বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তারা চার ভাই। পিতা মরহুম মোহাম্মদ ইউনুস, মাতা ওয়াসিমা খাতুনের জেষ্ঠ সন্তান ওয়াহিদ। গ্রামের ঐতিহ্যবাহী ভাদুর স্কুলেই তার শিক্ষাজীবনের সূচনা। শৈশব থেকেই মেধাবী তিনি। পরবর্তী সময়ে ইতিহাস খ্যাত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান নোয়াখালি জেলা স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় খুবই ভাল ফলাফল করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। তারপর পাড়ি জমান বরিশালে। সেখানে গিয়ে চাখার কলেজে ভর্তি হন উচ্চমাধ্যমিকে। এরপর অর্থনৈতিক কারণে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করতে না পেরে কলকাতায় চলে যান। সেখানে গিয়ে সুরেন্দ্রনাথ বঙ্গবাসী কলেজে রাতের শিফটে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন। এর মাঝে জীবিকা নির্বাহের জন্য বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থাকেন। দুই বন্ধু মিলে লন্ড্রি খুলে বসেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই লন্ড্রির ব্যবসা লাটে ওঠে। বেকার হয়ে পড়েন। পরে জড়িয়ে পড়লেন সাংবাদিকতায়। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ইত্তেহাদ পত্রিকায় কিছুদিন কাটালেন। হঠাৎ ইস্তফা। আবার বেকার। হেথাওথা ঘুরে বেড়ান। সন্ধ্যা নামলে কলকাতার রাতকে হৃদয়ে নিয়ে তালতলার ১৮ নম্বর মেসবাড়িতে ঢুকে পড়েন। আবারও চাকরির সন্ধান। চাকরি জুটে গেল এজি অফিসে। এবারও চাকরি পাল্টালেন। এবার ঢুকলেন পোস্ট রেইড ইনফরমেশন সেন্টারে। এখানে কিছুদিন কর্মরত থাকার পর তদানীন্তন বোম্বাইতে এক অবাঙালির ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে একাউন্টেন্ট হিসাবে কিছুদিন পার করলেন। তারপর আবার পেশা বদল। এবার লয়েডস ব্যাংক। আবার ইস্তফা, কলকাতার অলিগলি রাজপথে ঘুরতে ঘুরতে এজরা স্ট্রিটের প্রাচীরে লাগানো একটা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখলেন। দি মুসলিম কর্মাশিয়াল ব্যাংক লিমিটেডে নিম্নমান সহকারীর পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে- এ মর্মে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। আবদুল ওয়াহিদ আবেদন করলেন। নিয়োগপত্র হাতে পেয়ে ১৯৪৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে সীমান্ত অতিক্রম করে সরাসরি ঢাকায় এসে মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখায় যোগ দিলেন। অল্পকিছু দিনের মধ্যে সততা, নিষ্ঠা দ্বারা ঊর্ধ্বতন মহলের আস্থাভাজন হয়ে উঠলেন। এরপর গ্রেড অনুযায়ী তার পদোন্নতি হতে লাগল। বদলিও হতে হলো চাকরির নিয়ম অনুযায়ী। কখনও ময়মনসিংহ, কখনও চট্টগ্রাম, কখনও খুলনা, আবার চট্টগ্রাম, তারপর ঢাকায়। সুপারিনটেন্ডেন্ট অব ব্রাঞ্চেস হয়ে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে লাগলেন। ডিজিএম (উপ-মহাব্যবস্থাপক) হিসেবে পদোন্নদি হলো।
তখন উত্তাল সময়। ঐতিহাসিক ৭ মার্চে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর বিভিন্ন কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়লেন ওয়াহিদ। একটা পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ অনুযায়ী তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলেন। এ ব্যাপারে তার সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন তারই সহকর্মী প্রয়াত খন্দকার খায়রুল বাশার। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এবং অন্যান্য শীর্ষ ছাত্র নেতৃবৃন্দ সবার সঙ্গেই নিয়মিত যোগাযোগ তখন ওয়াহিদের। হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। একপর্যায়ে ওয়াহিদকে হানাদার বাহিনী গ্রেফতার করে- দেশদ্রোহিতা, টাকা পাঠানো বন্ধ করা, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার জন্য। শেষ পর্যন্ত ছাড়া পেলেন। তবে শর্ত জুড়ে দিয়েছিল হানাদাররা- ঢাকা ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না ওয়াহিদ। দেশ স্বাধীন হলো। বঙ্গবন্ধুর সঠিক দিক নির্দেশনায় দেশের অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের সুদৃঢ় ভিত্তি নির্মাণের জন্য অন্যান্য ব্যাংক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে ওয়াহিদের ওপরও গুরু দায়িত্ব এসে পড়ে। ওয়াহিদ সে সময়ে রূপালী ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি লাভ করলেন, বঙ্গবন্ধু ওয়াহিদের মূল্যায়ন করলেন এই পদন্নোতি প্রদানের মাধ্যমে। এরপর ওয়াহিদ রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করে ব্যাংককে দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিচালনা করতে লাগলেন।
তিনি তখন একইসঙ্গে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। চাকরি তার আরও বছর দুয়েক ছিল কিন্তু স্বৈরাচার সরকার নায়কের নিকটজনের একটি অন্যায় আবদার তিনি সরাসরি নাকচ করে দেন। এর ফল হিসেবে তাকে ওসডি করা হলো। এরপর স্বৈরাচার সরকারের নায়কের নির্দেশে তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হলো ১৯৮২ সালের জুলাইয়ের পর। এর মধ্যে স্বৈরাচার সরকারের নায়কের নির্দেশে তাকে বিভিন্ন মামলায় জড়ানো হলো। সে ছিল এক দুঃসময়। আজ ওয়াহিদ ঢাকায়, কাল চট্টগ্রাম এভাবে বিভিন্ন সামরিক আদালতে মিথ্যা মামলার মুখোমুখি হতে তখন ওয়াহিদ ক্লান্ত, শেষ পর্যন্ত ওয়াহিদ নির্দোশ প্রমাণিত হলেন। দেশে কখন সবে বেসরকারি ব্যাংকের পথ চলা শুরু। ওয়াহিদ যোগ দিলেন উপদেষ্টা হিসেবে দি সিটি ব্যাংক লিমিটেড-এ। তারুণ্য এসে আবার ভর করল তার সবাঙ্গ জুড়ে। আবার সেই সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা, অধিকাংশ সময় সন্ধ্যা পার হয়ে রাত। ১০ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ওয়াহিদের নেতৃত্বে এই ব্যাংক একটা ভাল অবস্থানে পৌঁছাল। এই ব্যাংক থেকে বিদায় নেবার কিছুদিন পর তিনি একটি বেসরকারি বিমা প্রতিষ্ঠান মেঘনা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দিলেন। এটা একটা সাধারণ বিমা প্রতিষ্ঠান। ব্যাংকার এখন বিমা খাতে এলেন। তার এবং একাধিক নতুন কর্মীদের অদম্য প্রচেষ্টায় মেঘনা দাঁড়িয়ে গেল। তিনি মেঘনার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও আবেদনকারী উদ্যোক্তা পরিচালক।
এভাবে চলতে চলতে অসম্ভব কর্মশক্তিতে বলিয়ান মানুষটির ছন্দপতন হলো। তিনি চলে গেলেন ১৯৯৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। সকালে তিনি আর ঘুম থেকে উঠে মেঘনায় গেলেন না। তার মৃত্যুর পর সিটি ব্যাংক এক শোকবার্তায় উল্লেখ করে- এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে শুরু করে আজ যে অবস্থানে এসেছে এর নেপথ্যে প্রয়াত আবদুল ওয়াহিদ এর বিশেষ অবদান রয়েছে।
আবদুল ওয়াহিদ যেখানেই দায়িত্ব পালন করেছেন সেখানেই সকলকে আপন করে নিয়েছেন। প্রয়োজনে চাকরি, চিকিৎসা দিয়ে সবার উপকার করার চেষ্টা করেছেন। তিনি ছিলেন সদালাপি বিনয় স্বভাবের। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বাণিজ্যিক খাতে যারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তাদের দিক নির্দেশনা ও প্রতিষ্ঠা পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকিং সহযোগিতা দিতে কার্পণ্য করেননি।
৬০ দশকের শেষ দিকে বঙ্গবন্ধু একশভাগ বাঙালি মালিকানায় একাধিক ব্যাংক স্থাপন করতে চেয়েছেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- ক্যাপিটাল ব্যাংক ও বেঙ্গল কোঅপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড। এর একটিতে বঙ্গবন্ধু প্রয়াত আবদুল ওয়াহিদকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেবেন বলেও মনস্থির করেছিলেন, ওয়াহিদ তা জানতেন।
তিনি ছিলেন বন্ধুভাবাপন্ন, মুটে, মজুর, কৃষক, শ্রমিক থেকে শুরু করে সকল শ্রেণি পেশার মানুষের সঙ্গে তিনি মিশতে পারতেন অনায়াসে। যা তার স্বভাব জাত। শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক সংস্কৃতি কর্মীদের সঙ্গে নিবিঢ় যোগাযোগ ছিল। প্রেসক্লাব ছিল অন্যতম প্রিয় জায়গা, ওয়াহিদ ভাই নামে পরিচিত। স্বাধীনতা পরবর্তী ব্যাংকিং খাতকে পুনরুজ্জীবিত করতে ওয়াহিদ অন্যতম ভূমিকা পালন করেন। এ মানুষটি আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন।
বিশিষ্ট ব্যাংকার দিলওয়ার এইচ চৌধুরী আবদুল ওয়াহিদ সম্পর্কে বলেন, ব্যাংকার হিসেবে তিনি সিদ্ধান্ত নিতেন বিচক্ষণতার সঙ্গে। খুবই ধীরস্থির ছিলেন এ ব্যাপারে। তাঁর অভিজ্ঞতা ছিল অনেক। তিনি কখনও হটকারী ছিলেন না। তার অধীনে যারা কাজ করতেন তাদের তিনি কাজের ক্ষেত্রে সুযোগ দিতেন, অনেক কেয়ার নিতেন সকলের। জুনিয়রদের প্রতি সুদৃষ্টি ছিল। নিরলস পরিশ্রমী ছিলেন। আগাগোড়া তিনি ক্যারিয়ার ব্যাংকার ছিলেন।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ফয়েজ বলেছেন, প্রতিভাবান ব্যাংকার ছিলেন। ফ্রিল্যান্স করেছেন। অবজারভারে তিনি লিখেছেন। চমৎকার ইংরেজি লিখতে পারতেন। তার বাংলাও ছিল অনবদ্য। ব্যাংকিং ড্রাফট ছিল অসাধারণ এবং শিক্ষনীয়, অল্প কথায় পুরো চিত্র ফুটিয়ে তুলতেন। তিনি রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। আমি ছিলাম তার সন্তান তুল্য। সবাইকে আপন করে নেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তার। সবার নাম মুখস্থ রাখতেন, অনেক ফোন নম্বরও। স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের ব্যবসা বাণিজ্য সম্প্রসারণে তার অবদান রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, নূরানী ফ্লাউয়ার মিল স্থাপনে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। আটার মেশিন স্থাপন, প্রডাকশানে তার ভূমিকা ছিল উল্লেখ করার মতো। তিনি লোকেদের দুঃখে পাশে থেকেছেন, অনেককে চাকরি দিয়েছেন।
সিটি ব্যাংকের প্রাক্তন ডিএমডি সত্যগোপাল পোদ্দার বলেছেন, ওয়াহিদ সাহেব অত্যন্ত ভালবাসতেন আমাদের। মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলে ভেঙে পড়া ব্যাংক খাতকে গুছিয়ে আনতে যে কয়জন ছিলেন তিনি ছিলেন অন্যতম। রূপালী ব্যাংক তথা ব্যাংকিং খাতকে একটা পজিশনে নিতে পরিশ্রম করেছেন। তখন কোনো হেড অফিস ছিল না। মতিঝিলে শিফট করলেন। তখন ১৯৭২-এ মুসলিম কমার্শিয়াল, স্ট্যান্ডার্ড ও অস্ট্রেলেশীয় ব্যাংক এই তিনটা ব্যাংক মিলে রূপালী ব্যাংক হয়। অনেক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ছিলেন তিনি। মনসুর-উল আমীন, মুশফেক-উস-সালেহীন, আবদুল ওয়াহিদ কয়েকজন ব্যাংকার ছিলেন যারা এই খাতকে তুলে এনেছেন। ওয়াহিদ মানুষের পাশে ছিলেন। চাকরি দিয়েছেন। তার সময়ে ইউনিয়ন স্ট্রং ছিল। ইউনিয়নের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তিনি নিয়মিত আলোচনা করে সামঞ্জস্য রক্ষা করেছিলেন, যা ব্যাংকের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিক ছিল ওই সময়। তার সময়ে অনেক বেগবান হলো ব্যাংক খাত। যখন প্রাইভেট ব্যাংকগুলোর যাত্রা শুরু, ১৯৮৩ সালে তখন ওয়াহিদ সিটি ব্যাংকের অ্যাডভাইজার। সেখানে আমাকে পিকআপ করলেন। ব্যাংকের ডেভেলপমেন্টে অনেক অবদান রয়েছে তার। দেশ স্বাধীনের পরে প্রাইভেট ব্যাংক যাদের তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠে, তিনি তাদের মধ্যে প্রধানতম।
ঊর্ধ্বতন প্রাক্তন ব্যাংক কর্মকর্তা সৈয়দ সাইফুল্লাহ বলেছেন, আমি ১৯৭৪ সালে সিনিয়র প্রিন্সিপাল ছিলাম রূপালী ব্যাংকে। তিনি খুব স্নেহ করতেন। আমরা একটা জায়গায় বেটমিন্টন খেলতাম। খেলতে গিয়ে পড়ে আহত হলে হলি ফ্যামিলিতে নিয়ে যাই একজনকে। প্রথমে চিকিৎসা করাতে বেডে নিচ্ছিল না। সেখানে ওয়াহিদ সাহেব গেলেন, তার পরিচয় দিয়ে চিকিৎসা করালেন। শেষে রাত হলে আমাকে নিজে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ব্যাক করলেন। প্রতিটা লোক তাকে পছন্দ করতো। একবার ব্যাংকের ভল্টের চাবি হারিয়ে ফেলি। বাসায় গিয়ে খুঁজে পাইনি। ভাবলাম গাড়িতে পড়ে গেছে। ওয়াহিদ সাহেবের বাসায় গেলাম। তিনি আমাকে ডেকে ডিম-খিচুড়ি খাওয়ালেন। অফিসে এসে ডুপলিকেট চাবির ব্যবস্থা করে দিলেন, তিনি এর জন্য কোনো ফাইন করলেন না, বেতন থেকে কাটলেন না। সব তিনি ঠিক করে দিলেন। তিনি বললেন, লকটার চাবি চ্যাঞ্জ করে নিও। মনসুুর-উল-আমীন মারা যাওয়ার পর তিনি এমডি হন রূপালী ব্যাংকে। আবদুল ওয়াহিদ সব জটিলতা, প্রশাসনিক সমস্যা নিরসন করেন, সব কিছুর বি-নির্মাণ করেন তিনি। এমডি হলেও গাড়িতে ড্রাইভারের পাশে বসতেন। চালকের পেছনে বসতেন না। বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন ছিলেন। ওয়াহিদ বঙ্গবন্ধুকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন। সিম্পল লাইফ লিড করেছেন, অহঙ্কার ছিল না। তাকে আজিমপুরে তার কথা অনুযায়ী সাধারণ জনতার মতো দাফন করা হয়।
প্রাক্তন ব্যাংকার আহমদ পারভেজ সামসুদ্দীন বলেছেন, আবদুল ওয়াহিদ ১৯৮৩ সালে সিটি ব্যাংকে জয়েন করেন। ওই সময় বক্তব্য দিতিন তিনি, কিভাবে ব্যাংকিং খাতকে উন্নত করা যায়। ইন্টার ব্যাংক ট্রানজেকশান ও ধ্বংস স্তূপ থেকে কিভাবে দাঁড় করানো যায়। দুরূহ কাজ করেছেন, অসম্ভব সময়ে টেনে তুলে ধরেছেন এ খাতকে। তিনি বলতেন সব সময় কাস্টমার সার্ভিস ভাল করে দেওয়ার জন্য। একইসঙ্গে তিনি মানবিক ছিলেন। চালকের পাশে বসে যেতেন, পেছনে বসতেন না। অন্যের প্রভিডেন্ট ফান্ড, চাকরি যত্নের সঙ্গে দেখতেন। একটা জটিল লেখা খুব সহজ করে দিতেন দুই তিন লাইনে। তিনি বড় মাপের মানুষ ছিলেন। তার জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত থাকলেও প্রফেশনাল জীবনে সহনশীল ছিলেন। খুব নরম ছিলেন। রাগতেন না। কোনো সমস্যা নিয়ে কোনো ব্যাংকের ডিরেক্টরদের সঙ্গে কথা বলতে পিছপা হতেন না।
গ্রাফিক্স ডিজাইনার ও জাতীয় কবিতা পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ইউসুফ হাসান স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে লিড দিয়েছেন। তৈরি করেছেন। আজকে এর বিকাশ যে হয়েছে যাদের জন্য, সে কয়েকজনের মধ্যে তিনি অন্যতম। একটা সেক্টরের তিনি ইঞ্জিনিয়ার। বঙ্গবন্ধুর সময়ে কাজ করেছেন। উনার তত্ত্বাবধায়নে কিছু কাজ করেছি। তার মেঘনা ইন্স্যুরেন্সের জন্য কাজ করে দিয়েছি। ওনার মতো মানুষকে সবার জানা উচিত। তার অবদান ছিল অপরিসীম। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিনির্মাণে তিনি যোদ্ধার মতো ছিলেন। এ ক্ষেত্রে তার রেভ্যুলেশন এবং কাজ রয়েছে।
রূপালী ব্যাংকের প্রাক্তন ডিজিএম সৈয়দ এসএম হাসান বলেছেন, আবদুল ওয়াহিদ এক কথায় তুখোড় লোক ছিলেন। তার তুলনা হয়না। তার মতো ব্যাংকার এখনও আসে নি। তিনি নরমাল লাইফ লিড করতেন। তার সঙ্গে আমার ১৯৭২ থেকে পরিচয়। স্বৈরশাসক তাকে দলে ভেড়াতে না পেরে চাকরিচ্যুত করেন। তিনি অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন তাই তাকে সেক করা হয়। অন্যদিকে এরশাদও তার ওপর অমানবিক নির্যাতন করে চাকরিচ্যুত করেন। তিনি নিজের কাজ নিজেই করতেন। কোনো অহঙ্কার ছিল না।
কবি-সম্পাদক প্রয়াত বেলাল চৌধুরী বলেছিলেন, আমাদের ওয়াহিদ ভাই দিলখোলা মানুষ। অন্যরা ‘বাফুন’-এর মতো খাইখাই করে, ওয়াহিদ ভাই তেমনটা ছিলেন না। সৎ ছিলেন। যখনই তার কাছে কোনো উপকার বা ব্যবসায়িক স্বার্থের জন্য যারা গিয়েছে তিনি তা করে দিতেন। এখানেই তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি দিয়েই গেছেন, অন্যরা নেয়া ছাড়া কোনো কাজ করতেন না। প্রথিতযশা সাহিত্যিক, সম্পাদক রাহাত খান ওয়াহিদ এর মৃত্যুর পর ইত্তেফাকের উপ-সম্পাদকীয়তে লিখেছেন, ওয়াহিদ ভাই ছিলেন একজন উদার মনের মানুষ। একবড় ব্যাংকার কিন্তু বিন্দুমাত্র দম্ভ ছিল না তার। সবার সঙ্গে সহজভাবে মিশতেন। উপকার করতেন, স্নেহ করতেন, বয়োজেষ্ঠদের শ্রদ্ধাও করতেন। দেশের ব্যাংকিং খাতকে এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে ওয়াহিদ ভাইয়ের ভূমিকা ছিল ব্যাপক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাংকার প্রয়াত লুৎফর রহমান সরকার বলেছিলেন, ওয়াহিদ স্যার নিজেই একটি ব্যাংক।
আবদুল ওয়াহিদ ছিলেন ব্যাংকিং খাতের বাতিঘর। বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্ম ওয়াহিদকে অনুসরণ করে ব্যাংকিং পেশাকে আরও সমৃদ্ধ করবে বলে বিশ্বাস করা যায়। ওয়াহিদ তার কর্মের মধ্যেই বেঁচে থাকবেন। তার জ্ঞানের গভীরতা ছিল অতুলনীয়। ওয়াহিদ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ^সী ছিলেন আমৃত্যু।
আবদুল ওয়াহিদ-ই একমাত্র ব্যবস্থাপনা পরিচালক যিনি নিম্নমান সহকারী থেকে ব্যবস্থাপক পরিচালক হয়েছেন একই ব্যাংকে।