• শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫, ০৯:৫৩ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম:
বিএসএফ আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে কাঁটাতারের বেড়া দিলো সীমান্তে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে প্রতিদিন ২৫ লাখ ডিম উৎপাদনের লক্ষ্য প্রাণের স্বাস্থ্যের অবস্থা স্থিতিশীল ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে খালেদা জিয়ার। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের আনতে বন্ধ রাখা হয় ইত্যাদির শুটিং বঙ্গোপসাগরে দুইদিনে ধরাপরলো ১৯৫ মণ ইলিশ‌‌ যারা মাইনাস-টুর কথা বলে এটা তাদের মনগড়া: খসরু গণঅভ্যুত্থানে নিহত ছয়জনের মরদেহ পড়ে আছে ঢামেকের মর্গে গা‌ড়ির সি‌লিন্ডা‌র বি‌ষ্ফোর‌ণের আগু‌নে চারজ‌নের মৃত‌্যু নাসরিন আক্তার পরিচয় দেওয়ায় নিপুণ আটকে দিয়েছে ইমিগ্রেশন পুলিশ তামিম প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের দিকে তেড়ে যাওয়ায় শাস্তি পাচ্ছেন

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চরিত্রগুলোর জনপ্রিয়তায় একটুও ভাটা পড়েনি

আপডেটঃ : মঙ্গলবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৮

এখনকার তরুণদের বই পড়ার অভ্যাস কমে গেলেও একসময় পাঠ্যাভাস তৈরির পিছনে বিরাট ভূমিকা রেখেছে নানা রহস্য উপন্যাস, কমিক চরিত্র কিংবা গোয়েন্দা গল্প। তুমুল জনপ্রিয় এসব বই, গল্প ও চরিত্র প্রভাব ফেলেছে কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরে। এমন কিছু চরিত্র নিয়েই ‘প্রজন্ম’-এর এবারের আয়োজনে কথা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া কয়েকজন শিক্ষার্থী। সম্পাদনা করেছেন রিয়াদ খন্দকার ও গ্রন্থনা করেছেন সৈয়দ তাওসিফ মোনাওয়ার।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চরিত্রগুলোর জনপ্রিয়তায় একটুও ভাটা পড়েনি
>> সৈয়দ তাওসিফ মোনাওয়ার
ছোটবেলার সেই দিনগুলোর কথা মনে আছে? পড়তে বসে পাঠ্যবইয়ের ফাঁকে কমিক বা গল্পের বই লুকিয়ে পড়ার কথা। একদিকে সেই গল্পের রোমাঞ্চ, অন্যদিকে মায়ের কাছে ধরা পড়ার ভয়! কমিক বা গল্পের বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে কখন যে সময় পেরিয়ে যেত, খেয়াল থাকত না কারোরই। আবার বন্ধুদের মধ্যে সেসব বই অদলবদলের ঘটনাও ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। তখন বিনোদনের বড় একটা অংশ ছিল কার্টুনিস্ট প্রাণের বিখ্যাত চাচা চৌধুরী থেকে শুরু করে নারায়ণ দেবনাথের সৃষ্ট দুই মানিকজোড় নন্টে ফন্টে, ঝগড়াটে হাদা ভোঁদা অথবা বিশাল বপুর বাটুল দি গ্রেট প্রভৃতি। এ চরিত্রগুলো যেমন আনন্দ দিয়েছে, তেমনি পরোপকারী হওয়ার শিক্ষাসহ নানা ইতিবাচক বার্তাও দিয়েছে।
শুধু স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়ারাই যে এগুলোর পাঠক ছিলেন তা নয়, বিভিন্ন বয়সী মানুষও অবসরে বিনোদনের জন্য এসব কমিক সংগ্রহ করতেন। আরও পাওয়া যেত ফ্যান্টম, অ্যাডভেঞ্চার্স অব টিনটিন, মারভেল কমিক্সের সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান, আয়রনম্যান, এক্স-ম্যান ইত্যাদি। ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় অনূদিত সংস্করণও পাওয়া যেত বইয়ের দোকানে।
এ তো গেল কমিক স্ট্রিপের কথা। গোয়েন্দা গল্পের চরিত্র হিসেবে সত্যজিত্ রায়ের ফেলুদা বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু দুই-বাংলার পাঠকের কাছে সমান জনপ্রিয়। আর গোটা গোটা অক্ষরে ছাপা থ্রিলারের কথা বললে পাঠকের পছন্দের শুরুতেই আসবে কাজী আনোয়ার হোসেনের অনবদ্য চরিত্র মাসুদ রানার নাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকে শুরু হয়ে প্রায় পাঁচ দশক ধরে পাঠকের মনে স্থান করে আছে মাসুদ রানা। গল্পের বইয়ের সীমা ছাপিয়ে কয়েক প্রজন্মের চোখে মাসুদ রানা মানেই সুদর্শন ও দুর্ধর্ষ এক গোয়েন্দা। থ্রিলার গল্পের কথা বললে রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দার দুর্দান্ত জনপ্রিয়তার কথাও উল্লেখ করতে হয়। তিন বন্ধু—কিশোর, মুসা ও রবিনের একের পর এক রহস্য সমাধানের উদ্দেশ্যে ছুটে বেড়ানোর গল্প পড়তে পড়তে হারিয়ে যেতে হতো কল্পনার গভীরে। তখন চোখের সামনে ভাসত রকি বিচ, কিশোরের চাচা রাশেদ পাশা কিংবা মেরি চাচির মুখ!
এ বইগুলোর পাশাপাশি সর্বশেষ গত দুই যুগ ধরে পাঠকের কাছে দারুণভাবে জনপ্রিয় হয়েছে নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের তৈরি হিমু ও মিসির আলী। হিমু একজন বেকার যুবক, যে বেখেয়ালী ও উদাসীন। হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে রাস্তাঘাটে দিন-রাত ঘুরে বেড়ানো, আর মাঝে মাঝে ভবিষ্যদ্বাণী করে মানুষকে চমকে দেওয়াই হলো হিমুর কাজ। একটা প্রজন্মকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে এই চরিত্রটি। ফলে বাস্তবজীবনেও হিমুর আচার-আচরণ অনুকরণ করতে শুরু করে অনেকেই! হিমুর জন্ম নব্বই দশকের শুরুতে, আর শুরু থেকেই তা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। মিসির আলি চরিত্রটি হুমায়ূনের আরেক বিখ্যাত সৃষ্টি। মিসির আলীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিমুর পুরোপুরি বিপরীত। হিমু চলে যুক্তির বিপরীতে আর মিসির আলী অক্ষরে অক্ষরে যুক্তি মানেন। যুক্তি দিয়ে সবকিছুর ব্যাখ্যা খোঁজেন।
কমিকের চাচা চৌধুরী থেকে শুরু করে বইয়ের হিমু কিংবা মিসির আলী সবচেয়ে বড় যে কাজটা করেছিল, তা হলো মানুষের মাঝে বইয়ে ডুবে থাকার অভ্যাস তৈরি হয়েছিল।
‘বিনোদনের পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষাও দিয়েছে ‘চাচা চৌধুরী’’
—তাসফিয়া ফারাহ
ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এমন কোনো মানুষ কি আজকাল খুঁজে পাওয়া যাবে যে ঘরের দরজা খোলা রেখেই বাইরে বেরিয়ে পড়ে? তাও ভুলক্রমে নয়, বরং রোজ রোজ এবং ইচ্ছে করেই! চোরেরা কত চেষ্টা করে তার বাড়ির সব হাপিশ করে দিতে! মালিক বাইরে বেরুলেই চোর ডাকাতেরা তক্কে তক্কে থাকে, কিন্তু বাড়ির মালিকের মগজের ধারের সাথে পেরে উঠবে, সে সাধ্য কার! শুধু তা-ই নয়, বাড়ির মালিকের মাথায় লাল রঙের পাগড়ি, হাতে লাঠি, গায়ে ওয়েস্টকোট আর নাকের ঠিক উপরে পুরু সাদা রঙের ভারিক্কি গোঁফ; আর তার সঙ্গী কিনা এক অতিকায় দানব আকৃতির এলিয়েন! এরকম অদ্ভুত খামখেয়ালি স্বভাবের মানুষটির কথা বললেই যে ফিকশনাল চরিত্রটি চোখে ভাসে, তিনি হলেন ‘চাচা চৌধুরী’। ক্ষুরধার মস্তিষ্কের এ চরিত্রের স্রষ্টা প্রাণ কুমার শর্মা। ১৯৭১ সালে তিনি ‘লটপট’ নামে ভারতের একটি হিন্দি ম্যাগাজিনের জন্য এ চরিত্রটি সৃষ্টি করেন। চাচা চৌধুরীর সঙ্গী হলেন তার স্ত্রী বিনি, পোষা কুকুর রকেট ও জুপিটার গ্রহের এক দৈত্যাকার এলিয়েন সাবু। সাবুর বিশাল বপু কিন্তু বুদ্ধির স্থূলতা পাঠকদের হাস্যরসের খোরাক জোগায়। তবে চাচা চৌধুরীর স্ত্রী বিনি স্বভাবের দিক থেকে চাচা চৌধুরীর কিছুটা বিপরীত। চাচা চৌধুরী খুব ঠাণ্ডা স্বভাবের মানুষ হলেও তার স্ত্রী একেবারে হাড়ে হাড়ে দজ্জাল! হাতে রুটি বানানো বেলন নিয়ে তিনি চোর তাড়াতে সবসময় বদ্ধপরিকর থাকতেন! পত্রিকায় ‘চাচা চৌধুরী’ কমিক সিরিজটি শুরু হওয়ার পরপরই এটি শিশুদের মাঝে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে। গ্রামের যেকোনো মানুষের সমস্যায় চাচা চৌধুরীর বুদ্ধিদীপ্ত সমাধান, সাবুর পিঠে উঠে ভ্রমণ, গন্ধ শুঁকে বিপদের উপস্থিতি টের পাওয়া এবং সবকিছু ছাপিয়ে অপরাজেয় ব্যক্তিত্ব ও অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা চরিত্রটিকে শিশুদের কাছে অনেক গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল। এই সিরিজের একটি বিখ্যাত ডায়লগ ছিল, ‘চাচা চৌধুরী কি দিমাগ কম্পিউটার সে ভি তেজ চলতা হ্যায়!’
ছোটবেলার বড় অংশ কেটেছে চাচা চৌধুরীর রঙিন কমিক হাতে। এটি যে শুধু শিশুতোষ বিনোদনের উত্স তা নয়, এটি নৈতিক শিক্ষারও একটি অসাধারণ মাধ্যম। চাচা চৌধুরী বিভিন্ন মানুষের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড শনাক্ত করতেন এবং তাদেরকে অনুশোচনা করতে ও ভবিষ্যতে এসব কাজ আর না করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন।
‘কৈশোরের রঙিন দিনগুলোর রসদ ‘মাসুদ রানা’’
—সামিয়া তাহসীন হক
অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস
‘বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এক দুর্দান্ত, দুঃসাহসী স্পাই গোপন মিশন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশ-দেশান্তরে। বিচিত্র তার জীবন…’ আমার মনে হয় না এরপর আর কিছু বলার দরকার হবে। ইতোমধ্যে সবাই বুঝে গিয়েছেন যার সম্পর্কে বলছি, সে হলো কাজী আনোয়ার হোসেনের বাংলা সাহিত্যের থ্রিলার জগতের কালোত্তীর্ণ চরিত্র ‘মাসুদ রানা’।
কী এমন আছে এই মাসুদ রানায় যে বাংলা পাঠকসমাজ বুঁদ হয়ে আছে প্রায় পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে? প্রজন্মের পর প্রজন্ম মাসুদ রানাকে সানন্দে তুলে দিচ্ছে অনুজদের হাতে। আমার মনে আছে, বাসায় বই পড়ার একটা আবহ সবসময়ই ছিল। ছোটবেলায় সেবা প্রকাশনীর বই বলতে ‘তিন গোয়েন্দা’ই বুঝতাম। একটু বড় হওয়ার পর মায়ের তাকে দেখতে পেলাম থরে থরে মাসুদ রানার বই সাজানো! কিন্তু ধরতে গেলেই বকুনি! মনে জেদ চেপে গেল, কী আছে ওই মাসুদ রানায়, জানতেই হবে! এভাবেই লুকিয়ে লুকিয়ে মাসুদ রানা পড়া শুরু। কখনোবা পাঠ্যবইয়ের নিচে, কখনোবা রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে—এভাবেই কত যে মাসুদ রানা পড়েছি তার ইয়ত্তা নেই। মাঝে মাঝে লুকিয়ে স্কুলব্যাগে করে নিয়ে যেতাম বন্ধুদের দেখানোর জন্য। সে কী উত্তেজনা বন্ধুমহলে! আমার মনে হয়, ‘মাসুদ রানা’ আসলে একটি টাইমমেশিন, যেটা আমাদের কৈশোরে কল্পনার জগতকে বিকশিত করতে অসামান্য অবদান রেখেছে। কত ভয়ানক মিশন, কত দুর্ধর্ষ চরিত্রকে যে চোখের সামনে দেখতে পেতাম! এই মাসুদ রানার হাত ধরে হয়তো এমন এমন সব জায়গার বর্ণনা পেয়েছি, যেটা বাস্তব জীবনে কখনোই পাওয়া সম্ভব ছিল না। একদিকে কাহিনির ক্লাইম্যাক্সে চলে এসেছি, অন্যদিকে যেকোনো মুহূর্তে মায়ের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়—এই দুই মিলিয়ে যে থ্রিলিং সময় পার করেছি এখন সেসব ভাবলে মনে হয়, আসলেই শৈশব-কৈশোর অনেক রঙিন কাটিয়েছি।
কাজী আনোয়ার হোসেন তার অনবদ্য লেখনীতে যেভাবে বাঙালি পাঠকসমাজকে দেশি থ্রিলার বইয়ের মুখাপেক্ষী করেছেন, তার জন্য আমরা চিরকাল তার কাছে ঋণী থাকব। ‘মাসুদ রানা’ শুধু কোনো বই না, বিগত পাঁচ দশক ধরে প্রায় প্রতিটি কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের দিনগুলো রঙিন করার রসদ।
‘গল্পচ্ছলে ইতিহাস, সাহিত্য ও রোমাঞ্চ—সবকিছুই দিয়েছে ‘কাকাবাবু’’
—আবির ইয়াসার
কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
ক্লাস ফাইভ কি সিক্সে পড়ার সময় প্রথম যখন কাকাবাবু পড়ি, তখন বেশ হতাশ হয়েছিলাম। তিন গোয়েন্দা, ফেলুদা আর শার্লক হোমসের ভক্ত হয়ে তখন কেবলই গোয়েন্দা গল্প খুঁজি। কে যেন বলল কাকাবাবুর কথা। পড়লাম ‘কাকাবাবু ও ব্ল্যাক প্যান্থার’। পড়ে বুঝলাম, কাকাবাবু মোটেও গোয়েন্দা না! হতাশ হলেও তখনো খেয়াল করিনি যে বইটা পড়ে ফেলেছি এক বসায়! হ্যাঁ, এটাই কাকাবাবু সিরিজের সবচেয়ে বড় গুণ। এত সাবলীল আর প্রাঞ্জল বর্ণনা মনকে টানে সহজেই। আর এ কারণে পাঠ্যবইয়ের ভিতরেও লুকিয়ে পড়তাম কাকাবাবু।
কাকাবাবু ভালো লাগত যতটা না এর কাহিনির জন্য, তারচেয়ে বেশি এর ভাষা আর চরিত্রগুলোর বৈচিত্র্যের জন্য। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসাধারণ লেখনীর গুণে চরিত্রগুলো জীবন্ত মনে হতো। মূলচরিত্র কাকাবাবু হলো সরকারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, প্রত্নতত্ত্ববিদ। এক পা খোঁড়া, কিন্তু কী দারুণ মনোবল! কাশ্মির থেকে হিমালয়, আন্দামান থেকে আসাম… সবখানে ছুটে যান রহস্যের সমাধানে। রহস্যভেদী হলেও কাকাবাবুর মধ্যে কিন্তু পুলিশ পুলিশ ভাব নেই। গল্পচ্ছলে এই কবিতা আবৃত্তি করছেন, এই ভূগোল জানাচ্ছেন, তো খানিকবাদে জানাচ্ছেন ইতিহাস। আর রোমাঞ্চ তো পুরোটা জুড়েই।
পড়তে পড়তে অনেকেই হয়তো চাইত কাকাবাবু হতে, কিন্তু আমি চাইতাম সন্তু হতে যার কাকাবাবু পরিচয়েই পরিচিত হয়েছেন রাজা রায় চৌধুরী। কিশোর বয়সী আমি ভাবতাম, যদি সন্তুর মতো সাহসী হতে পারতাম, যে কাকাবাবুকে খুব ভালোবাসে।
কাকাবাবুর বইগুলোর আরেকটি বিষয়ের কথা না বললেই নয়—খাবার! কাকাবাবুর বইয়ে খাবারদাবারের কথা এমনভাবে লেখা থাকে যে ক্ষুধা না পেয়ে উপায় নেই। কত রকমারি খাবারের কথা আছে এর পাতায় পাতায়, ইয়ত্তা নেই!
কাকাবাবুর কাহিনিগুলোকে গোয়েন্দাগল্প না বলে অ্যাডভেঞ্চার বলা ভালো। ভিন্নধর্মী রহস্য নিয়ে লেখা একেকটি গল্প। এ নিয়ে কথা বলে শেষ করা যাবে না।
‘তিন গোয়েন্দা’র একেকটি বই ছিল একেকটি রোমাঞ্চ’
—তানজিব রুবাইয়াত খান
মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ
ছোটবেলায় পড়া বইগুলোর মধ্যে তিন গোয়েন্দাই ছিল সবচেয়ে প্রিয়। বরাবরই আমি থ্রিলার প্রিয় মানুষ, আর আমার মনে হয় সেটা বিকাশ লাভ করেছে ছোটবেলায় তিন গোয়েন্দা পড়ার মধ্য দিয়েই। একেকটি বই ছিল একেকটি রোমাঞ্চ। রকিব হাসান বা শামসুদ্দীন নাওয়াবের তিন গোয়েন্দার মূল গল্প তিনজন কিশোরকে ঘিরে। ওরা তিন বন্ধু, যারা তাদের আশপাশে চলতে থাকা বিভিন্ন ঘটনার সত্যতা উদঘাটনে ছুটে বেড়ায়। শখের গোয়েন্দা হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠে। তাদের রহস্যের জালভেদ করার আগ্রহ এবং একের পর এক অ্যাডভেঞ্চার বইটিকে দারুণভাবে জনপ্রিয় করে তোলে।
তিন গোয়েন্দা তিন কিশোর বন্ধুর কাহিনি হলেও, এখানে প্রধান চরিত্রে দেখা যায় কিশোর পাশাকে। ছোটবেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় মা-বাবাকে হারানো কিশোর পাশা বড় হয়েছেন আমেরিকার রকি বিচে চাচা-চাচির কাছে। কিশোরের কোকড়ানো চুল আর বুদ্ধিদীপ্ত চোখই তার চরিত্রটিকে সিরিজটির প্রধান গোয়েন্দা হিসেবে পাঠকের সামনে তুলে ধরে। তার চরিত্রের মূল আকর্ষণ ছিল দৃষ্টিশক্তি ও দূরদর্শিতা। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই গোয়েন্দার চোখে যেমন ফুটে ওঠে তার অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ততা তেমনি তার চোখে এড়ায় না কোন ক্ষুদ্র ব্যাপারও। মূলত চরিত্রটির এমন কিছু আচরণই কিশোরকে আলাদা করে বাকি দুটি গোয়েন্দা চরিত্র থেকে। এ ছাড়াও কিশোর ইলেকট্রনিক্সের কাজে বেশ পটু, সে সাধারণত কিছুটা গম্ভীর প্রকৃতির, এমনকি রহস্য উদঘাটনের সময়েও ঠিক সময় ছাড়া সে কাউকে কিছুই বলে না।
সিরিজটিতে তার সহযোগী গোয়েন্দা চরিত্রে দেখা যায় মুসা আমান ও রবিনকে। এখানে মুসা আমান আফ্রিকান বংশোদ্ভূত বাদামি চুলের শ্বেতাঙ্গ কিশোর। গোয়েন্দা কার্যকলাপে সেই মূলত কিশোর পাশার মূল সহযোগী। তিন কিশোরের মধ্যে আমানই সবচেয়ে লম্বা, পেশিবহুল ও মারামারিতে পটু। আর অন্যতম চরিত্র রবিন মিলফোর্ড আইরিশ-আমেরিকান, তার কাজ তিনজনের দলের সবকিছুর রেকর্ড রাখা, তাদের পুস্তকগত সমাধান দেওয়া এবং রহস্য সমাধানকালে পাওয়া কাগজপত্র ও নথি সংরক্ষণ করা। তিনজনের মধ্যে রবিনই একমাত্র চশমা পড়ে, এবং গঠনে তার বাকি দুই সাথির চেয়ে ছোট। এই তিন কিশোরের ‘তিন গোয়েন্দা’ কয়েক যুগ ধরে কয়েক প্রজন্মের মনে খোরাক জুুগিয়েছে।
‘শৈশব-কৈশোরকে মুগ্ধতার বেড়াজালে আটকে রেখেছিল ‘ফেলুদা’’
—তাপসী দে প্রাপ্তি
অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
প্রদোষ কুমার মিত্তির, ডাকনাম ফেলু! নামটা পড়লেই চোখে ভাসে শাণিত ক্ষুরধার বুদ্ধিদীপ্ত একটি চেহারা, যার কাছে আদতে কোনো রহস্যের মীমাংসা করাই অসম্ভব নয়। সত্যজিত্ রায়ের তুমুল জনপ্রিয় রোমাঞ্চ সিরিজ ‘ফেলুদা’ শৈশব-কৈশোর থেকেই মানুষকে যে মুগ্ধতার বেড়াজালে আটকে ফেলে, তার তুলনা অন্য কিছুর সাথে হয় না। লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু এবং তপেশ রঞ্জন মিস্ত্রী ওরফে তোপসেকে সাথে নিয়ে রজনী সেন রোডের বাড়িতে থাকা ফেলুদা রহস্যের জাল উন্মোচন করতে কখনো ছুটে বেড়াতেন পাহাড়ে, কখনোবা সমুদ্রে! ফেলুদা আমার প্রথম পড়া হয় যখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। এই সিরিজের প্রত্যেকটি উপন্যাসই এত চমত্কারভাবে লেখা, পড়ে মনে হতো ফেলুদা, তোপসে ও জটায়ুর সাথে আমিও যেন কোনো দূরদেশে যাচ্ছি কোনো রহস্য ভেদ করতে। কৈলাসে কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে সোনার কেল্লা কিংবা বাদশাহী আংটি, প্রতিটি উপন্যাসই একইরকম দুঃসাহসিক অভিযান আর অ্যাডভেঞ্চারের অনুভূতি দেয়।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে ব্যাপারটি, রহস্যের সুতোর পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে ফেলুদা কখনোই একঘেয়ে হয়ে যায়নি, কখনোই বিরক্তি আসেনি, জটায়ুর হাস্যরসাত্মক কথা কিংবা তোপসের মতো একজন সহযাত্রীই সবসময় গল্পের পাশাপাশিও অন্যরকম একটি সম্পর্কের কথা জানান দেয়। ফেলুদা যেভাবে রহস্যের জট খুলে ফেলতেন, ঘুলঘুলিয়ার ভিতরের ধোঁয়াশা কিংবা মঘনলাল মেঘরাজের মতো ভয়ংকর অপরাধীর সাথে কথোপকথন করতেন, তাতে তার চরিত্র, ব্যক্তিত্ব আরও আকর্ষণীয় হয়ে ধরা দেয় পাঠকের কাছে। সিধু জ্যাঠার অফুরন্ত তথ্যের ভাণ্ডার সেই সাথে ফেলুদাকে করে তোলে সমৃদ্ধ। এখনো বইয়ের পাতা খুললে কিংবা কোনো রহস্যের গন্ধ পেলেই চোখে ভাসে ফেলুদার চরিত্র, জটায়ু আর তোপসেকে সাথে নিয়ে চারমিনারের ধোঁয়া উড়িয়ে ০.৩২ কোল্টের রিভলবারটা তাক করে এগোচ্ছেন কোনো এক রহস্যের সুতো ধরে। এটি বলা যেতেই পারে, সত্যজিত্ রায়ের ‘ফেলুদা’ সব শ্রেণির, বয়সের, সময়ের পাঠকের কাছে চিরযৌবনা।
‘যুক্তির সিঁড়ি বেয়ে নানা অসঙ্গতির সমাধান শেখায় ‘মিসির আলী’’
—মাহবুবুর রহমান তাহমীদ
লোকপ্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
নিত্যদিনের জীবনে মাঝেমধ্যে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যার উত্তর সাধারণ দৃষ্টিতে আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। ব্যাখ্যাতীত ধরে নিয়ে আমরা অনেকসময় ঘটনাগুলোকে আলৌকিক বা ভৌতিক হিসেবে ভাবতে শুরু করি! তবে মিসির আলী চরিত্রটি সাধারণ মানুষদের থেকে একটু আলাদা। সাধারণভাবে যেসব ব্যাপার অতিপ্রাকৃত কিংবা ব্যাখ্যার অতীত মনে হয় নিজের তীক্ষ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে খুব সহজেই সেগুলোর উত্তর বের করে ফেলেন তিনি!
এই মিসির আলী মানুষটা কে? এই উত্তর নিশ্চয়ই এদেশের পাঠকসমাজের কারোই অজানা নয়। নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম এক জনপ্রিয় সৃষ্ট চরিত্র এই মিসির আলী। তিনি এমন একজন মানুষ যিনি গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে ভাবতে পছন্দ করেন, বিজ্ঞানে বিশ্বাস করেন, অস্বাভাবিক ঘটনাগুলোকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করেন। আবার ব্যক্তিগত জীবনে তিনি লেখক হুমায়ূন আহমেদের মতোই সাদামাটা, কোনোরকম বিলাসিতা নেই, নিজেকে একটু গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। উপন্যাসের কাহিনি অনুসারে, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক, যার কাছে প্রায়ই মানুষজন নিজেদের জীবনের ব্যাখ্যাতীত ঘটনাগুলোর সমাধান চাইতে আসে! যুক্তির সিঁড়ি বেয়ে সেগুলোর সমাধান করেন তিনি। প্রায় বিশের অধিক উপন্যাস রয়েছে মিসির আলীকে নিয়ে, যেগুলোর একটাতে লেখকের সৃষ্ট আরেক জনপ্রিয় চরিত্র হিমুকে তার কাছে সাহায্য চাইতে দেখা যায়!
মিসির আলী চরিত্রটি আমাদের ভাবতে শেখায়, যুক্তির সিঁড়ি বেয়ে নানা অসঙ্গতির সমাধান করতে শেখায়! প্রচলিত কুসংস্কারের গণ্ডি থেকে বের হয়ে বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে নিজেদের জীবনকে সহজতর করতে পারি সেই শিক্ষা আমরা মিসির আলীর থেকে পাই! তাই তো গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মিসির আলী চরিত্রটি এদেশের পাঠকসমাজের কাছে সমাদৃত হয়েছে, জনপ্রিয়তা দেশের সীমানা পেরিয়ে পৌঁছিয়েছে ওপার বাংলায়! হূমায়ূন আহমেদ নেই, কিন্তু তার সৃষ্ট মিসির আলী বেঁচে রবে বহুকাল।
হিমুর ছবিটি এঁকেছেন কার্টুনিস্ট মুহাম্মদ আয়ান। বাকি চরিত্রগুলোর ছবি সংগৃহীত। 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ