বাজারে চাহিদা ও জোগানের ব্যবধানের কারণে ডলারের সংকট আরও তীব্র হয়েছে। এতে টাকার মান কমে যাচ্ছে। বাড়ছে ডলারের দাম। রেমিট্যান্স আয়ে প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ না হওয়া, রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে ধীরগতির বিপরীতে ব্যাপকহারে আমদানি বেড়ে যাওয়ায় এমন অবস্থা তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে ডলার ছেড়েও পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারছে না।
বৈদেশিক মুদ্রাবাজার ঠিক রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার লেনদেনের বিষয়ে বিভিন্ন সীমা বেঁধে দিলেও তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। নীতিমালা উপেক্ষা করে মূল্যের বাইরে গিয়ে ডলার বেচা-কেনা করছে ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম আবারো বেড়েছে। অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে প্রতি ডলারে ৫ পয়সা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৮৩ টাকা ৯৫ পয়সায়। গত অক্টোবরে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের দাম ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সা মূল্য বেঁধে দেয়। এরপর থেকে পর্যায়ক্রমে ডলারের দাম বাড়ছে। তবে এক রকম ঘোষণা দিয়ে আরেক দামে ডলার বিক্রির অভিযোগ রয়েছে ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে। এর আগে মিথ্যা ঘোষণা দেওয়ার দায়ে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী বেশিরভাগ ব্যাংককে সতর্ক করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনকালীন সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ তেমন বাড়েনি। এ সময় আমদানি বিল পরিশোধে ডলারের চাহিদা কিছুটা বেড়েছে। ফলে নির্বাচন পরবর্তীতে বাজারে আবারো ডলারের সংকট প্রকট হচ্ছে।
ডলারবাজার স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে। চলতি অর্থবছরের (২০১৮-১৯) ছয় মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ১২২ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত অর্থবছরে (২০১৭-১৮) বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে ২৩১ কোটি মার্কিন ডলার বিক্রি করে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ভিন্ন চিত্র ছিল। ওই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা বাজার থেকে মোট ১৯৩ কোটি ১০ লাখ ডলার কিনেছিল। আর বিক্রি করেছিল মাত্র ১৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আর ডলার বিক্রি করায় কমে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। গত সপ্তাহের শেষে রিজার্ভ কমে প্রায় তিন হাজার ১০০ কোটি (৩১ বিলিয়ন) ডলার হয়ে যায়। যেখানে গত বছর একই সময়ে তিন হাজার ২০৭ কোটি (৩৩ বিলিয়ন) ডলার ছিল।
গত ২১ মে থেকে ডলার ৮৩ টাকা ৭০ পয়সায় স্থিতিশীল ছিল। পরে ২৮ জুন থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আন্তঃব্যাংক ডলারের মূল্য ছিল ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সা। এভাবে পর্যায়ক্রমে বাড়তে বাড়তে এখন ৮৩ টাকা ৯৫ পয়সা হয়ে গেছে। এক ব্যাংক অন্য ব্যাংকের কাছে যে দামে ডলার বেচাকেনা করে, তা আন্তঃব্যাংক দাম হিসেবে বিবেচিত। টাকা-ডলার বিনিময় হার পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ের তুলনায় এক টাকা ১৫ পয়সা বেড়েছে। আর ২০১৬ সালের অক্টোবরের প্রথমে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ৭৮ টাকা ৪০ পয়সা। সে হিসাবে আড়াই বছরে পাঁচ টাকা ৫৫ পয়সা বেড়েছে। আন্তঃব্যাংক লেনদেনের বাইরে কার্ব মার্কেটে (খোলা বাজারে) ডলারের দাম আরও বেশি। ৮৬ টাকা ছাড়িয়েছে প্রতি ডলারের দাম।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, রপ্তানি, রেমিট্যান্স আয়ের সঙ্গে আমদানি ব্যয়ের একটা অসামঞ্জস্য হয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। এর ফলে দাম বেড়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখার জন্য কাজ করছে। এ বিষয়ে এবিবির সঙ্গে বৈঠকও হয়েছে।
আরো পড়ুন: বিশ্বে জুতা উৎপাদনে অষ্টম বাংলাদেশ
এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি আনিস এ খান বলেন, ব্যাংকগুলো প্রচুর পরিমাণে এলসি (ঋণপত্র) খুলে রেখেছে। সেগুলোর সেটেলমেন্ট করার জন্য প্রচুর ডলারের প্রয়োজন হচ্ছে। ফলে অনেকক্ষেত্রেই ব্যাংকগুলো বেশি দামে ডলার কিনতে বাধ্য হচ্ছে। এতে বৈদেশিক বাণিজ্যে ব্যাংক লাভের বদলে ক্ষতিতে পড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেখা গেছে, রেমিট্যান্স আয়ে প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত হারে হচ্ছে না। মাঝে মাঝেই এ খাতের আয় অনেক কমে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ৭৪৯ কোটি ৬৭ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি প্রবাসীরা। যা আগের বছরের চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি। এ সময়ে রপ্তানি আয়েও কাঙ্ক্ষিত গতি আসেনি। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরে প্রথম ছয় মাসে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে আয় করেছে দুই হাজার ৫০ কোটি ডলার। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ দশমিক ৪২ শতাংশ। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে আমদানিতে ৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অবশ্য ডিসেম্বরের হিসাব যুক্ত হলে আমদানি প্রবৃদ্ধি আরও বাড়বে।