আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তার সব কিস্তি পেতে ৩৮ শর্তের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ইস্যু অন্যতম। এমনকি রিজার্ভের পরিমাণ দেখানোর বিষয়ে একটি হিসাব কাঠামোও নির্দিষ্ট করে দিয়েছে আইএমএফ। শর্ত অনুযায়ী আগামী জুলাই মাস থেকে সংস্থাটির বেঁধে দেওয়া পদ্ধতি অনুযায়ী রিজার্ভের অর্থ হিসাব করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। এর আগের মাস জুনে নিট রিজার্ভ থাকতে হবে ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। বর্তমান নিট রিজার্ভের সঙ্গে আরও ৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি যোগ হলে পূরণ হবে এই লক্ষ্যমাত্রা। এরই মধ্যে এপ্রিল শেষের দিকে। হাতে বেশি দিন সময়ও নেই। সেক্ষেত্রে জুন মাস নাগাদ আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এখন নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ২ বিলিয়ন ডলার পাওয়ার আশা রয়েছে। ইতোমধ্যেই বিশ^ব্যাংক ১.২৫ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ১২৫ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশকে। প্রবাসী আয়, রপ্তানি আয় ও উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে যে অর্থের যোগান আসার কথা তা পেলে রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বেগ পেতে হবে না। জুলাই নাগাদ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে।
যদিও গতকাল বিশ্বব্যাংকের বোর্ড অব এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টরসের বৈঠকে বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন কান্ট্রি পার্টনারশিপ ফ্রেমওয়ার্ক (২০২৩-২৭) আলোচনা করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশের নতুন তিনটি প্রকল্পে ১.২৫ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন অনুমোদন করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে রিজার্ভের বিষয়টি অত্যধিক গুরুত্ব পেয়েছে। বাংলাদেশের কর্মকর্তারা রিজার্ভের হিসাব উপস্থাপন করার পর উভয়পক্ষ তা নিয়ে কথা বলেন। কীভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো যায়, তা নিয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে।
ওই বৈঠকে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দলের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের গ্রস বা মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ৩১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে নিট রিজার্ভ প্রায় ২৩ বিলিয়ন। তবে খুব দ্রুত পরিশোধ করতে হবে- এমন অর্থ বাদ দিয়ে আইএমএফের হিসাবে বাংলাদেশের নিট রিজার্ভের পরিমাণ প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলার। আগামী জুন নাগাদ তা ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার শর্ত রয়েছে সংস্থাটির।
তবে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার কমানো এবং বিশ্বব্যাংক, এডিবি, এআইআইবি ও জাইকাসহ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে জুনের মধ্যে প্রত্যাশিত ২ বিলিয়ন ডলার প্রাপ্তি নিট রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়তা করবে বলে মিশনকে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক জানান, বর্তমানে গ্রস বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ৩১ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। জুনে নিট রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের আশা তো রয়েছেই। তবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতি এবং মুদ্রানীতি নিয়ে মিশনের (আইএমএফ প্রতিনিধি দল) সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আগামী জুলাই থেকে গ্রস এবং আইএমএফ নির্ধারিত পদ্ধতিতে রিজার্ভের পরিমাণ ঘোষণা করা হবে।
গত ৩০ জানুয়ারি আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। এর তিন দিন পরই প্রথম কিস্তিতে ছাড় করে ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার। ২০২৬ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে মোট সাত কিস্তিতে দেবে ঋণের পুরো অর্থ। এ ঋণ নিতে ছোট-বড় ৩৮টি শর্ত পূরণ করতে হবে বাংলাদেশকে। শর্তের অন্যতম হচ্ছে, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে আনার মাধ্যমে সরকারের ব্যয় সক্ষমতা বাড়ানো।
এদিকে সামগ্রিক ভর্তুকি আইএমএফ নির্ধারিত সীমায় আটকে রাখতে সরকার ইতোমধ্যে সারের দাম বাড়িয়েছে। পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দামও তিন দফা বাড়ানো হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে দুই দফা এবং মার্চে এক দফা ৫ শতাংশ করে গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয়। এর আগে গত বছরের নভেম্বরে পাইকারি পর্যায়ে ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। আগামী জুনের মধ্যে আরও এক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের, যা ইতোমধ্যেই আইএমএফ প্রতিনিধি দলকে অবহিত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
অন্যদিকে গত বছরে আগস্ট মাসে পেট্রোল ও অকটেনে ৫০ শতাংশ এবং ডিজেল ও কেরোসিনে ৩৬ শতাংশ দাম বাড়ায় সরকার। শিল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন, হোটেল ও রেস্তোরাঁর গ্যাসের দামও গত ফেব্রুয়ারি থেকে বাড়ানো হয়েছে। প্রাকৃতিক গ্যাসের দামও গত বছরের জুনে গড়ে ২৩ শতাংশ বাড়ানো হয়। জ্বালানি তেলের মূল্য আগামী সেপ্টেম্বর থেকেই তিন মাস পরপর আন্তর্জাতিক বাজারদরের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে।
এ ছাড়া বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কাকে উপেক্ষা করে এই কর্মসূচি চলাকালে সরকার এই ভর্তুকি না বাড়াতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ধীরে ধীরে ভর্তুকি আরও কমানোর উপায় খুঁজছে বলেও এরই মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আইএমএফকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।