• শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৪৪ পূর্বাহ্ন

নজরুলের রাজনৈতিক দর্শন

নিউজ ডেস্ক
আপডেটঃ : বৃহস্পতিবার, ২৫ মে, ২০২৩

শাহীনুর রেজা

ঊনবিংশ শতকের শেষ বা বিংশ শতকের দ্বিতীয়-তৃতীয় দশকের বিস্তৃত রাজনৈতিক পটভূমিতে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব। এই সময়ের পটভূমিতে নজরুল লালিত হন এবং তাঁর সামাজিক রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ ঘটে। বিশেষ করে মহাযুদ্ধোত্তর বিভিন্ন আন্দোলন নজরুল ইসলামকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এর ফলে তিনি কিছু কিছু সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত হয়ে পড়েন। রাজনীতিতে সক্রিয় ব্যক্তিরা সাধারণত আন্দোলন এবং সভা-সমিতি, মিছিল-মিটিং কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাঁদের চাওয়া-পাওয়াকে তুলে ধরেন। নজরুলের বেলায় বাড়তি যোগ হয়েছে তাঁর ক্ষুরধার লেখনি।

এজন্য তাঁকে অন্যান্যের তুলনায় অনেক বেশি রাজরোষানলে পড়তে হয়েছে। মুক্তি সংগ্রামের ভাবপ্রবণ আদর্শ তাঁকে বেশি প্রভাবিত করেছে। তই জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের অগ্রনায়কদের নিয়ে (যেমন− লোকমান্য তিলক, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন প্রমুখ) তিনি কবিতা, গান, প্রবন্ধ রচনা করেন। কবির মনে ঢেউ স ার করে বিদেশি বিপ্লববাদ আন্দোলনের ইতিহাসও। তাঁর কবি কল্পনাকে উদ্দীপ্ত, অনুপ্রাণিত করেছিল গোপীনাথ সাহা, ক্ষুদিরাম বসু, সূর্যসেন, যতীন দাস প্রভৃতি শহীদদের দুঃসাহসিক কার্যকলাপ। এছাড়া নজরুল কমিউনিস্ট আন্দোলনের দ্বারাও প্রভাবিত হন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজফ্ফর আহমদ নজরুলের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন বলে স্বাভাবিকভাবে এ দলের অনেক কিছু তাঁকে প্রভাবিত করে। তাঁর লেখক ও রাজনৈতিক জীবনকে বলিষ্ঠ করে।

সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিপ্লববাদী আদর্শে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। দেশের শৃঙ্খল মুক্তির জন্যে সন্ত্রাসবাদীদের বিপ্লবাত্মক প্রয়াস তাঁর চিত্তে রেখাপাত করেছিল। স্বাধীনতা বলতে তিনি কেবলমাত্র ইংরেজের হাত থেকে দেশের ধনিক সম্প্রদায়ের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর, একচেটিয়া ব্যবসায়ীদের আরো বেশি মুনাফার পথ করে দেয়া, সমস্ত জমিদারদের শাসন ক্ষমতা লাভের কথা কিংবা কেবল মধ্যবিত্তের সুযোগ-সুবিধা লাভের কথা চিন্তা করেননি। এই শ্রেণির চিন্তাধারা থেকে তিনি নিজেকে দূরে রাখেন। স্বাধীনতা তাঁর কাছে ছিল শোষিত মানুষের মুক্তি ও মেহনতি মানুষের প্রাপ্যের অধিকার।

নজরুলের বিপ্লবের উদ্দেশ্যই ছিল মানুষের মনের স্বাধীনতার আকাঙ্খা জাগরিত করা, সে স্বাধীনতা মানব মনের সর্বোদয় অর্থাৎ ধর্মে, সমাজে, অর্থনীতিতে ও রাজনীতিতে সর্বক্ষেত্রে স্বাধীনতা।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে যে বিদ্রোহী সত্ত্বা, তাঁর রচনার পরতে পরতে যে শোষণমুক্ত সমাজ, শৃঙ্খলমুক্ত কর্মজীবী মানুষ, স্বাধীন দেশের উর্বর জমি ইত্যাদি নানা মানবতাবাদ প্রসঙ্গ− এ

সবকিছুর স্পিড তিনি পেয়েছিলেন ১৯১৭ সালে সিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলের ছাত্র থাকাকালীন শিক্ষক নিবারণচন্দ্র ঘটকের কাছে। নিবারণচন্দ্র ঘটক শুধুমাত্র নজরুলের শিক্ষক ছিলেন না, তিনি ছিলেন রাজনৈতিক দীক্ষা গুরুও। নজরুলের অন্তরে তিনি স্বাধীনতা ও বিপ্লবী আকাঙ্খার স ার করেছিলেন। নিবারণচন্দ্র স্কুল জীবনে নিখিল ভারত বিপ্লবী সংগঠনের কর্মি ছিলেন। তাঁর মাসিমা প্রথম নারী বিপ্লবী দু-কড়ি বালা দেবী। নিবারণ ঘটক দেশের স্বাধীনতা ও বৈপ্লবিক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতেন। সেই স্বপ্নের বীজ তিনি নজরুলের মধ্যে বপন করেছিলেন।

সিয়ারশোলের পরের অধ্যায় নজুরুলের সৈনিক জীবন। সেখানে তিনি অবসরে বিপ্লবী পত্র-পত্রিকা পড়তেন, রাজদ্রোহমূলক কাগজ-পত্র আনতেন, আনতেন সরকার নিষিদ্ধ পত্রিকা, সংবাদ রাখতেন আইরিশ বিপ্লব, রুশ বিপ্লবের। তাঁর কাগজ-পত্রের তলায় চাপা থাকতো সিডিশান কমিটির রিপোর্ট। গোপনে তিনি সেসব পড়তেন। এসব কিছুই ছিল কাজী নজরুলের রাজনৈতিক সচেতনতার বহিঃপ্রকাশ।

পল্টন থেকে ফিরে এলে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে মুজফ্ফর আহমদ একদিন নজরুলকে বললেন, ‘‘এই পরিস্থিতিতে আপনার কর্তব্য কি বলে আপনি মনে করেন? শুধুই সাহিত্য করবেন, নাকি রাজনীতিও করবেন?’’ নজরুল পরিস্কার ভাষায় জানালেন, ‘রাজনীতি যদি না করবো তো যুদ্ধে গিয়েছিলাম কেন’। নজরুল এবং মুজফ্ফর আহমদের কথা-বার্তায় রাজনীতিতে নজরুলের সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্পষ্ট হয়।

১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে নজরুল যখন প্রত্যক্ষ রাজনীতি শুরু করেন এবং তাঁর রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা শহর ও মফঃস্বলে পরিব্যাপ্তি হয় তখন দেশে স্বাধীনতার জন্য উত্তাল আন্দোলন। বৃটিশের শাসন আর ভারতবাসী মানতে চায় না। রাজনীতিতে ‘কংগ্রেস’ নামক রাজনৈতিক দলের নেতা মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, চিত্তরঞ্জ দাস, সুভাসচন্দ্র বসুসহ আরো অনেক।

অন্যদিকে বিপ্লববাদীরা বোমা মেরে, গুলি করে ইংরেজদের দেশ ছাড়া করতে চায়। বৃটিশ সরকার তাদেরকে সন্ত্রাসবাদী বলে গাগা-গাল দিত। নজরুলকে এ দলের লোকেরা বেশি ভালোবাসতো। নজরুরও তাঁদের ভালোবাসতেন। বৃটিশদের নিয়ে তিনি অনেক কবিতা লিখেছেন−

এ দেশ ছাড়বি কিনা বল
নইলে মারের চোটে হার করিব জল।

অনেক বিপ্লববাদীদের বৃটিশ সরকার ধরে নিয়ে গিয়ে ফাঁসি দিয়ে মেরে ফেলেছে। কংগ্রেসের অধিকাংশ নেতা বিপ্লববাদীদের সরাসরি আঘাত করাটা পছন্দ করতেন না। তাঁরা বৃটিশদের এক ধরনের তোষামোদি করতেন। নজরুল এই তোষামোদি পছন্দ করতেন না। তাই কংগ্রেসের প্রতি

তাঁর আস্থা ছিল না। তিনি সরাসরি আঘাত করাটাই চাইতেন, নইলে বৃটিশ ভারত ছাড়বে না।
১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে মহাত্মা গান্ধী গিয়েছিলেন হুগলিতে। সেখানকার চাঁদনী ঘাটে বিশাল সামিয়ানা খাটিয়ে মহাসভার ব্যব¯’া করলেন হুগলি স্বদেশি আন্দোলনের কর্মীরা। গান্ধীজিকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ‘বাঙলায় মহাত্মা’ শিরোনামে নজরুল গান লিখলেন−
আজ না-চাওয়া পথ দিয়ে কে এলে
ঐ কংস কারার দ্বার ঠেলে,
আজ শব-শ্মশানে শিব নাচে ঐ
ফুল ফুটানো-পা ফেলে। 
গান্ধীজিকে নজরুল প্রথম দিকে খুব ভালোবাসতেন। সে কারনেই এ প্রশংসা করেন। কিš‘ তিনি যখন পরবর্তী সময়ে অহিংস আন্দোলনের ডাক দেন তখন নজরুল তাঁর পথ পরিহার করেন। নজরুল উপলদ্ধি করেছিলেন যে, গান্ধীজির আন্দোলনে দেশে স্বাধীনতার পথ সুগম হবে না। কারণ তিনি বিপ্লববাদী আন্দোলনকে ইংরেজের সুরে গণ্য করেন সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন হিসেবে। গুধু তাই নয়, বিপ্লবী ভগৎসিং-এর ফাঁসির জন্য গান্ধীজি সই করেছিলেন। নজরুল তখন গান্ধীজির সমালোচনা করেন।
গান্ধী চান স্বরাজ। অর্থাৎ স্বাধীনতা নয়, স্বায়ত্তশাসন। কিš‘ নজরুল চান ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা। তিনি গান্ধীজির পথকে পরিহার করে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার মাধ্যমে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চান। ‘ধূমকেতুর পথ’ প্রবন্ধে নজরুল লিখলেন−
‘‘স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেননা, ও কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-রক্ষা, শাসনভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোনো বিদেশীর মোড়লী করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না।
আগেই বলেছি, নজরুল প্রত্যক্ষ রাজনীতি শুরু করেন ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে। নজরুল এই সময়ে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সদস্য হন। নজরুলের অন্যতম রাজনৈতিক সহকর্মী হেমন্তকুমার সরকার কংগ্রেসের সভ্য হওয়া সত্তে¦ও কৃষক আন্দোলনে অধিকতর উৎসাহী ছিলেন। জেলে ও চাষীদের অনেক সভা-সমিতিতে তারা যোগ দিতেন। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের শেষে দিকে কাজী নজরুল ইসলাম, হেমন্তকুমার সরকার, কুৎবুদ্দীন আহমদ ও শামসুদ্দীন হুসয়নের উদ্যোগে। কলকাতায় একটি নতুন পার্টি গঠিত হয়। পার্টির নাম ‘ভারতীয় জাতীয় মহাসমিতির অন্তর্ভুক্ত মজুর স্বরাজ পাটির্’ (ঞযব খধনড়ঁৎ ঝধিৎধল চধৎঃু ড়ভ ঃযব ওহফরধহ ঘধঃরড়হধষ ঈড়হমৎবংং) বা ‘শমিক প্রজা স্বরাজ দল’। এই দলের প্রথম ইশ্তেহার কাজী নজরুল ইসলামের দস্তখতে প্রকাশিত হয়েছিল।
পার্টি গঠন হবার সাথে সাথেই তার মুখপাত্ররূপে ‘সাপ্তাহিক লাঙল’ পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়। ২৬ ডিসেম্বর ১৯২৫ সালে লাঙল-এর প্রথম খণ্ড বিশেষ সংখ্যা প্রকশিত হয়।
নজরুলের পরিচালনায় ‘লাঙল’ পত্রিকা নিয়ে ১০ আগস্ট লেলিনগ্রাদের প্রাচ্য ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক আলী দাউদ আলী দত্ত নামে পরিচিত বাংলার প্রখ্যাত বিপ্লবী প্রমথ দত্ত একটি পত্রে লেখেন, ‘‘ভারতের অত্মোৎপন্ন সম্পদে বি ত সম্প্রদায়ের (চৎড়ষবঃধৎরধঃ) জাগরণশীল শ্রেণি চৈতন্যের লাঙল-ই প্রথম মুখপত্র’’।
১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণনগরের বাড়ি থাকা অস্থায় পূর্ব বঙ্গ থেকে নজরুল ইসলাম কেন্দ্রীয় আইন সভার নির্বাচনে প্রার্থী হলেন।
৩১ অক্টোবর মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ঢাকা সফর করেন এবং প্রায় পুরো নভেম্বর মাস তিনি ময়মনসিংহ, বাকেরগঞ্জ ও ফরিদপুর জেলার নির্বাচনী জনসংযোগ করেন। কিš‘ ঐ সময়ে নজরুলের পক্ষে পূর্ব বাংলার কোন মুসলমান আসন থেকে নির্বাচনে জয়লাভ করা কঠিন ছিল। কারণ গোঁড়া মুসলমান সম্প্রদায় ইতিপূর্বেই তাঁকে কাফের ফতোয়া দিয়েছিল। নজরুল নিজেও এ ব্যাপারে সচেতন ছিলেন।
২৯ নভেম্বর ১৯২৬ তারিখে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হলে দেখা যায় যে, নজরুল নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন এবং তাঁর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। নির্বাচনে জয়লাভ করেন বরিশালের জমিদার মুহম্মদ ইসমাইল চৌধুরী ও টাঙ্গাইলের জমিদার আবদুল হালিম গজনবী।
এরপর ১৯২৯ খ্রিস্টব্দের শেষে সপ্তাহে কাজী নজরুল ইসলাম ও মুজফ্ফর আহমদ একটি কৃষক সম্মেলনে যোগ দিতে কুষ্টিয়া যান। কলকাতা থেকে আবদুল হালিম, গ্রেট বৃটেনের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ফিলিপ স্প্র্যাট ও ত্রিপুরা থেকে ওয়াসিমউদ্দিন ঐ সম্মেলনে যোগ দেন। সম্মেলনের প্রতিনিধিদের কাছে নজরুল ছিলেন অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। সেখানে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের পরামর্শক্রমে বঙ্গীয় কৃষক লীগ-কৃষকদের একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। কিš‘ ২০ মার্চ মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় মুজফ্ফর আহমদ গ্রেফতার হলে তা সম্ভব হয়নি। মুজফ্ফর আহমদ বলছেন− ‘কুষ্টিয়ার ওই সভাতেই আমি নজরুলের সঙ্গে রাজনীতিক মে  শেষ দাঁড়িয়েছিলাম’।
রাজনীতিতে স্বার্থক না হলেও নজরুলের বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল। এর প্রথম কারণ হিসেবে বলা যায়− বাংলার মাটি ও মানুষের সাথে গভীর নৈকট্য। দ্বিতীয় কারণ: বিভিন্ন শ্রেণির ব্যতিক্রমি কাব্যধারা এবং তৃতীয় ও বলিষ্ঠ কারণ: কবির রাজনৈতিক দর্শন, দেশে ও মানুষের মুক্তির সংগ্রামের দর্শন।
লেখক: সাহিত্য ও সংগীত ব্যক্তিত্ব


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ