সম্প্রতি পুলিশের অনুমতি নিয়ে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিস্টিটিউটে সমাবেশ করার পর আবারও আলোচনায় এসেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এনিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানান জল্পনা-কল্পনা। এরমধ্যেই নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এক মন্তব্য। এ নিয়ে বিবৃতিও দিয়েছে জামায়াত। এরপর ফখরুল পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেও তাতে সন্তুষ্ট নয় জামায়াত।
বিএনপি-জামায়াতের জোট ভাঙার খবর আগেই পাওয়া গেছে। আর গেল ১০ জুন ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জামায়াতকে সমাবেশ করতে সরকারের অনুমতি এবং সর্বশেষ মির্জা ফখরুলের মন্তব্য এই দূরত্বকে আরও স্পষ্ট করছে।
ঈদের পরদিন ৩০ জুন ঠাকুরগাঁওয়ে জামায়াত নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, মুখে মুখে জামায়াত বিরোধিতার ধোঁয়া তুললেও সরকারের সঙ্গে জামায়াতের যোগাযোগ এখন স্পষ্ট হয়েছে। সরকারের লোকেরাই বলছে, অন্যান্যরাও বলছে।
পরদিন, ১ জুলাই জামায়াতের পক্ষ থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এ টি এম মাছুম বিবৃতি পাঠিয়ে ফখরুলের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান।
বিবৃতে তিনি বলেন, বিএনপি মহাসচিবের এই বক্তব্যে জনগণ হতাশ হয়েছে। আমরা বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্য সর্বোতভাবে প্রত্যাখ্যান করছি।
এতে আরও বলা হয়, ‘জামায়াতে ইসলামী কোনো ফ্যাসিস্ট, স্বৈরাচার ও জালেমের সঙ্গে আঁতাত, সমঝোতা বা যোগাযোগ করে কখনো রাজনীতি করে না। করার প্রশ্নই আসে না। কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠা ও এক দফার আন্দোলনের জন্য গোটা জাতি যখন ঐক্যবদ্ধ, তখন এই জাতীয় বক্তব্য সরকারবিরোধী আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে জনগণের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
একইদিন বিএনপি মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেন, পুরো বিষয়টিতেই মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে। আমার বক্তব্য গণমাধ্যমে সঠিকভাবে উদ্ধৃত করা হয়নি। জামায়াত একটা রাজনৈতিক দল, অনেক দিন ধরে রাজনীতি করছে, জাতীয় পার্টিও রাজনৈতিক দল। যদিও এখন জামায়াতের নিবন্ধন নেই। আমি ঠাকুরগাঁওয়ে যে কথাটা বলেছিলাম- জামায়াতে ইসলামী একটা রাজনৈতিক দল, সে তার নিজস্ব ধারায় রাজনীতি করছে।
কিন্তু বিএনপি মহাসচিবের এই কথায় সন্তুষ্ট নয় জামায়াতে ইসলামী। দলটির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এবং কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ ডয়চে ভেলেকে বলেন, আমরা বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যের পর ৩৬ ঘণ্টা অপেক্ষা করেছি। তিনি তার বক্তব্য সংশোধন করেননি। আমরা বিবৃতি দেওয়ার পর তিনি যা বলেছেন, তা স্পষ্ট নয়। তিনি তো বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক এখন স্পষ্ট। আমরা তো আমাদের বিবৃতিতে সেটা উল্লেখ করে দিয়েছি। তিনি তো সেটা সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ করেননি তার কথায়। তার আরও পরিষ্কার করে বলা উচিত ছিল যে, এ জাতীয় কথা তার বলা ঠিক হয়নি। কিন্তু সেটা তিনি করেননি।
অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, আমি মনে করি এটা উনার বক্তব্য। বিএনপির নীতি নির্ধারকদের কেউ ওনার বক্তব্য সমর্থন করেননি।
মির্জা ফখরুলের ঠাকুরগাঁয়ের বক্তব্যের পর বিএনপির নেতাদের সঙ্গে জামায়াত নেতাদের কথা হয়েছি কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, যোগাযোগ আমাদের সঙ্গে তাদের বিভিন্ন লেভেলেই হয়েছে। তারা তখন বলেছেন, এই বিষয়টি নিয়ে তারা বিব্রত।
দুই দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, তাদের মধ্যে অবিশ্বাস এবং সন্দেহ বাড়ছে। বিএনপির একাংশ অনেক আগে থেকেই জামায়াতবিরোধী। সেই অংশ মনে করছেন, ১০ জুন জামায়াতের সমাবেশ সরকারের সঙ্গে কোনো সমঝোতার ফল। তারা এটাও মনে করছেন, বিএনপি নির্বাচনে না গেলে জামায়াতকে নিবন্ধন ফিরিয়ে দিয়ে নির্বাচনের মাঠে নামাতে পারে সরকার। আর বিএনপি নির্বাচনে গেলেও জামায়াতকে আর জোট করতে না দিয়ে আলাদা নির্বাচন করানো হবে। তাতে ভোটের হিসেবে শাসক দল আওয়ামী লীগ লাভবান হবে।
মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, আমরা বিএনপির সঙ্গে জোটে নেই অনেক দিন ধরেই। তবে সরকারবিরোধী আন্দোলনে আছি। আমরা কেয়ারটেকার সরকার চাই, উনারাও চান। আমরা একটা ফ্রেশ নির্বাচন চাই। ওনারাও চান। দাবির ক্ষেত্রে আমাদের অমিল আছে, অভিন্নতাও আছে। আমাদের রাজনৈতিক সম্পর্ক আছে।
নির্বাচন ও জোট প্রশ্নে তিনি বলেন, জামায়াত ইসালমীর এককভাবে সারাদেশে নির্বাচনের সক্ষমতা আছে। কিন্তু কীভাবে নির্বাচন হবে, প্রক্রিয়া কী হবে? নির্বাচন আমরা এককভাবে করব, না জোটগতভাবে করব, তা বলার সময় তো এখনো আসেনি।
তার কথা, আমরা ১৩ বার আবেদন করার পর সমাবেশের অনুমতি পেয়েছি। আমাদের এতগুলো নেতাকে হত্যার পর এই সরকারের সঙ্গে সমঝোতার প্রশ্নই ওঠে না। আর কেয়ারটেকার সরকার হলে আমরা নিবন্ধনও পাব।
এদিকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান মনে করেন, জামায়াতকে সমাবেশ করতে দেওয়ার পেছনে সরকারের কোনো দূরভিসন্ধি আছে। সরকার এখন নানা ধরনের চাপের মুখে আছে। মার্কিন ভিসা নীতির পর সরকার এখন দিশেহারা হয়ে গেছে।
জামায়াতকে সমাবেশ করতে দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের একেক নেতা একেক ধরনের কথা বলছেন বলেও জানান এই বিএনপি নেতা।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রাজ্জাক সাহেব বলেছেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সেই রাজনীতিটা কী? নির্বাচনের আগে এখন আবার জঙ্গি তৎপরতার কথা বলা হচ্ছে। সরকারবিরোধী আন্দোলন সামনে যখন আরও জোরদার হবে, জামায়াত মাঠে নামবে। তখন হয়তো বুঝাতে চাইবে এই জামায়াত গোষ্ঠী, জঙ্গি গোষ্ঠী নিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় যেতে চায়।
রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত সভা-সমাবেশ করার চেষ্টা করতেই পারে জানিয়ে আহমেদ আযম খান বলেন, সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু জামায়াতকে সতর্ক থাকতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে, সরকারের দূরভিসন্ধি নিয়ে।
তিনি বলেন, বিএনপি এখন জোটগত আন্দোলন করছে না। তাই বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের জোট নেই। এখন রাজনৈতিক দলগুলো যার যার অবস্থান থেকে যুগপৎ আন্দোলন করছে।
এখন জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির যোগাযোগ হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, এখন জামায়াতের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ হয় না। জোট নেই, যোগাযোগও নেই। জামায়াতের সঙ্গে ভবিষ্যতে জোট হওয়ার সম্ভাবনাও আপাতত দেখছি না।
জানা গেছে, বিএনপি আপাতত জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে চায় মূলত দুই কারণে। প্রথম, জামায়াতের কোনো কাজের দায় তারা নিতে চায় না এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখাতে চায় যে, ওই ধরনের রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নেই। আর জামায়াত নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের শরীকদের একাংশেরও আপত্তি আছে। তাই, বিএনপি তার জোটেও জামায়াতকে রাখেনি।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি কেন দেওয়া হলো, এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই ভালো বলতে পারবে। একদিকে, আপনারা গণতন্ত্রের কথা বলবেন, সভা-সমাবেশের কথা বলবেন। আবার সমাবেশের অনুমতি দিলে আঁতাতের কথা বলবেন। এটা তো পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা।
তার কথা, মির্জা ফখরুল সাহেব কী ভুলে গেছেন, তাদের নেতা তারেক রহমান ছাত্রশিবিরের সমাবেশে গিয়ে বলেছিলেন, ছাত্রশিবির এবং ছাত্রদল একই মায়ের পেটের দুই সন্তান। উনি বলেছিলেন, জামায়াত ইসলামী এবং বিএনপি ভাই ভাই। জামায়াত-বিএনপি দুইটি দলেরই উৎস এক। পাকিস্তানের সৃষ্টি। জামায়াত সৃষ্টি করেছে পাকিস্তানের মওদুদী, আর বিএনপি সৃষ্টি করেছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই জিয়াউর রহমানের হাত দিয়ে।