এ দায় অর্থ মন্ত্রণালয় তথা অর্থমন্ত্রী এড়াতে পারেন না -ব্যাংক বিশ্লেষকদের মন্তব্য * বাড়ছে ঋণ জালিয়াতি, খেলাপিদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার যেন কেউ নেই * সাধারণ আমানতকারীরা বিপাকে
ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক লুটপাট অব্যাহত আছে। দেদারসে চলছে দুর্নীতি আর ঋণ অনিয়ম। কয়েকটি ব্যাংকে ভয়াবহ ঋণ জালিয়াতির তথ্য গা শিউরে ওঠার মতো। নতুন কার্যক্রমে আসা ফারমার্স ব্যাংকের অবস্থাও আলোচিত বেসিক ব্যাংকের দশায় ধরেছে। উভয় প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অস্তিত্বহীন সাইনবোর্ডসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে ফারমার্স ব্যাংকের সীমাহীন আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের কারণে পুরো ব্যাংকিং খাত ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। একই পরিস্থিতি এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকেও। ৭০১ কোটি টাকা ঋণ অনিয়মের দায়ে ব্যাংকটির এমডির চাকরি যায় যায় অবস্থা। দীর্ঘ তদন্ত প্রক্রিয়া শেষে তার ভাগ্য ঝুলে আছে গভর্নরের হাতে।
এছাড়া প্রতিদিনই বিভিন্ন ব্যাংকের কোনো না কোনো ভয়াবহ অনিয়ম, দুর্নীতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। এ সেক্টরকে বেশি অস্থির করে তুলেছে ঋণ জালিয়াতি। ফলে খেলাপি ঋণের লাগাম কোনোভাবেই টেনে ধরা যাচ্ছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ঋণ জালিয়াত ও খেলাপিদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেয়ার যেন কেউ নেই। বিদ্যমান ৫৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে বর্তমানে ১৮টি ব্যাংক নানাভাবে আর্থিক ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে এক ডজনেরও বেশি ব্যাংকের অবস্থা খুবই নাজুক। বাকিগুলো ‘ঝুঁকি স্কোরে’ আসা-যাওয়ার মধ্যে আছে। এভাবে দীর্ঘদিন থেকে আর্থিক খাতে বড় ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন ব্যাংকগুলোর লাখ লাখ আমানতকারী। প্রশ্ন হল- আর্থিক খাতের এ অস্থিরতার দায় কে নেবে? পর্যবেক্ষক মহলসহ এমন প্রশ্ন এখন সবার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ব্যাংকিং বিশ্লেষকদের কয়েকজন জানিয়েছেন, অবশ্যই এ দায় অর্থ মন্ত্রণালয় তথা অর্থমন্ত্রী এড়াতে পারেন না। কারণ দেশে একটি সরকার আছে। আছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও ব্যাংক নিয়ন্ত্রণকারী বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের অনেক নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান। শুধু সরকারি নয়, বেসরকারি ব্যাংকের এসব লুটপাটের দায় সরকারের দায়িত্বশীলরা এড়াতে পারবেন না। কেননা ব্যাংকের অনুমোদন তো রাস্তার কেউ দেয়নি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বেসরকারি খাতের যেসব ব্যাংকের মালিক রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশে অর্থ মন্ত্রণালয়কে থাকতে হবে। তা না হলে লুটপাট বন্ধ হবে না। এছাড়া সরকারি ব্যাংকে অনিয়মের দায় কিছুতে অর্থ মন্ত্রণালয় এড়াতে পারে না। মূলত পুরো ব্যাংকিং খাতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটা প্রভাব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিরাজমান।
এদিকে বেসরকারি খাতের ফারমার্স এবং এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। রোববার সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় উত্থাপিত ফারমার্স ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতিসহ নানা অনিয়মের প্রতিবেদন পড়ে সভাপতিসহ উপস্থিত প্রত্যেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অবিলম্বে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি ড. আবদুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের বলেন, ‘ব্যাংকগুলো যেসব অনিয়ম করেছে তা পড়লেই গা শিউরে ওঠে। এসব অনিয়মের দায় পরিচালনা পর্ষদকে নিতে হবে। তারা এ অনিয়মের দায় এড়াবে কিভাবে?’
প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে বেসরকারি খাতে অনুমোদন পাওয়া ৯ ব্যাংকের মধ্যে খেলাপি ঋণের শীর্ষে আছে ফারমার্স ব্যাংক। ওই বছরের জুনে যাত্রা শুরু করা ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ গত জুন শেষে হয়েছে ৩০৬ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের এপ্রিলে যাত্রা করা এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৯১ কোটি টাকা। সংসদীয় কমিটির সভায় উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ফারমার্স ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে ধার করে চলছে। নিচ্ছে উচ্চ সুদে আমানত। নিয়ম মেনে বাংলাদেশ ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে না পারায় গত এক বছরে সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জরিমানা গুনেছে ব্যাংকটি। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, আমানতকারীদের অর্থ পরিশোধেরও ক্ষমতা হারিয়েছে ফারমার্স ব্যাংক। ব্যাংকটি পুরো ব্যাংক খাতকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে, যা আমানতকারীদের আস্থা নষ্ট করতে পারে।
অপরদিকে প্রবাসীদের উদ্যোগে গঠিত এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের মূলধন জোগান থেকে ঋণ দেয়াসহ সব ক্ষেত্রেই বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শহীদুল আহসানকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে। অনিয়মের জন্য এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দেওয়ান মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত শুনানি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চূড়ান্ত পর্যায়ে অপরাধ প্রমাণিত হলে যে কোনো সময় তাকে চাকরিচ্যুত করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংকিং খাতের এমন বেহালদশা সম্পর্কে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্র্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয়েছে। সংসদীয় কমিটি সুপারিশ করতে পারে। কিন্তু ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা রাখে না। এটি মন্ত্রণালয় বা বাংলাদেশ ব্যাংককেই করতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি-অনিয়মের দায় প্রথমে পরিচালনা পর্ষদসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে নিতে হবে। এরপর এ দায় এড়াতে পারবে না বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থাৎ সব পক্ষকে কমবেশি দায় নিতে হবে। একপক্ষীয় কোনো অনিয়ম হয় না। তিনি বলেন, ফারমার্স ও এনআরবিসির ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি যে সুপারিশ করেছে তা কোনোভাবে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। সুপারিশগুলো অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংককে বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না হলে ব্যাংকিং খাতের লুটপাট বন্ধ হবে না।
সূত্র জানায়, বিভিন্ন ঋণ অনিয়মের কারণে ফারমার্স ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ছাড়াও রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, বেসিক, রূপালী, কৃষি, বিডিবিএল এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে খেলাপি ঋণের ছড়াছড়ি অবস্থা। যার পরিমাণ ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত হয়েছে। যেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। মূলত এ কারণেই ব্যাংকগুলো চরম আর্থিক ঝুঁকিতে রয়েছে। এর বাইরে এবি ব্যাংকে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ২ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা সিঙ্গাপুরে পাচার হওয়ার তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের অবস্থা আরও ভয়াবহ। ব্যাংক দুটিতে অনিয়মের কারণে খেলাপি ঋণ হয়েছে ৭০ থেকে ৯৫ শতাংশ। বিদেশি হাবিব ব্যাংকেরও খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন সময় অনিয়মের কারণে ইউসিবিএল, ন্যাশনাল ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক ও সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি ধীরে ধীরে খারাপের দিকে যাচ্ছে।