ইরান ও চীনের পর এবার ভারতের সাথে রাশিয়ার বাণিজ্যিক সখ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র। সেই দুঃশ্চিন্তা থেকেই এবার ভারতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার কথা জানিয়ে সতর্ক করল যুক্তরাষ্ট্র।
২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত শুরুর পর থেকেই রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলো। সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে নয়াদিল্লিকেও তারা ক্রমাগত চাপ দিয়েছে। যদিও ভারত সেই চাপ অগ্রাহ্য করে একের পর এক চুক্তি করে চলেছে মস্কোর সাথে।
রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট করতে চায়নি ভারত। তাই যুক্তরাষ্ট্রের চোখরাঙানিকে অগ্রাহ্য করে রাশিয়ার সাথে ভারতের দ্বি-পক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ২০২৩ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় পাঁচ লাখ ৪৫ হাজার ৪৬৬ কোটি রুপিতে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই অঙ্ক প্রায় ৮৪ লাখ কোটিতে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় রয়েছে ভারত।
তাই এবার সরাসরি বাণিজ্যিক আঘাত হানতে বদ্ধপরিকর যুক্তরাষ্ট্র। ক্ষেপণাস্ত্র বা প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করা সম্ভব, এমন যন্ত্রাংশ বা প্রযুক্তি অথবা সরঞ্জাম রাশিয়াকে সরবরাহ করার পরিণাম সম্পর্কে সচেতন করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
যে ভারতীয় সংস্থা রাশিয়ার সাথে এই ধরনের বাণিজ্যের প্রয়াস চালাবে, উভয় সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে হলে সতর্ক করেছে তারা।
বিবিধ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়, এমন প্রযুক্তি সরবরাহে অভিযুক্ত থাকার জন্য গত বছরের নভেম্বরে বেঙ্গালুরু কেন্দ্রিক এক বেসরকারি সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র।
বৈদ্যুতিক উপাদান, যন্ত্রাংশ, ড্রোন এবং ড্রোনের জন্য সফটওয়্যার হলো কিছু দ্বৈত ব্যবহারের সামগ্রী, যা অসামরিক এবং সামরিক উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা যেতে পারে।
ভারতীয় সংস্থাগুলোকে নির্দিষ্ট ধরনের পণ্য, যেমন রাসায়নিক, বিমানের যন্ত্রাংশ এবং ক্ষেপণাস্ত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে, এমন উপাদান রফতানি না করার গুরুত্ব সম্পর্কে বার বার সচেতন করে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র।
রাশিয়ার সাথে প্রতিরক্ষা সমঝোতা ছিন্ন করার ‘বার্তা’ দিয়ে রাশিয়ার সাথে ‘সামরিক সহযোগিতা’ নিয়ে ভারতকে প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারি দিয়ে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র, এমনটাই কূটনৈতিক মহলের একাংশের ধারণা।
রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে ডলার বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক মুদ্রায় লেনদেন ব্যবহারে বাধা থাকায় সরাসরি রুপি ও রুবলের মাধ্যমে বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার চুক্তি করেছে ভারত-রাশিয়া।
বিশেষ এক ধরনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সাহায্যে অন্যান্য মুদ্রায় রূপান্তর করার প্রয়োজন ছাড়াই সরাসরি রুপিতে বাণিজ্য চালিয়ে আসছে দু’দেশ। এই ব্যাংক অ্যাকাউন্টকে ভোস্ট্রো বলা হয়ে থাকে।
রাশিয়ান ব্যাংকগুলো সরাসরি লেনদেন করার উদ্দেশ্যে একাধিক ভারতীয় সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। বাণিজ্যিক এক সংস্থার সূত্র বলছে, ভারতের কাছে তেল বা প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের মতো পণ্য বিক্রি করে ভারতেই সেই টাকা বিনিয়োগ করার সুযোগ রাশিয়াকে দিয়ে রেখেছে ভারত।
গত বছরের ডিসেম্বরে রাশিয়ার সাথে ব্যবসা করা বিদেশী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া রাশিয়ার সামরিক শিল্পের সাথে লেনদেনে যে সব বিদেশী ব্যাংকের সংযোগ আছে, তাও খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে বলে জানানো হয় তখন।
বার্তাসংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুসারে, সেই সূত্র ধরেই ভারতে ইন্ডিয়ান ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশনকে চিঠি পাঠায় ওয়াশিংটন। মার্কিন সহকারী অর্থসচিবের সেই চিঠিতে বলা হয়েছিল, যেসব বিদেশী আর্থিক প্রতিষ্ঠান রাশিয়ার সামরিক শিল্প-সংক্রান্ত ব্যবসার সাথে যুক্ত হবে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সাহায্য হারাতে পারে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলোর জারি করা আর্থিক নিষেধাজ্ঞায় সায় দেয়নি ভারত। যুদ্ধের আবহে রুশ পরারাষ্ট্রমন্ত্রী ভারত সফরে তেল বিক্রি নিয়েও আলোচনা করেছেন।
ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপানসহ বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর তিরস্কার শুনতে হয়েছে রাশিয়াকে। তবে এই যুদ্ধ নিয়ে নিজেদের অবস্থান এখনো স্পষ্ট করেনি সাউথ ব্লক।
আগামী ২৩ আগস্ট ইউক্রেন সফরে যাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তবে যুদ্ধ বন্ধের জন্য রাশিয়ার সাথে মধ্যস্থতা করবে না ভারত, মোদির ইউক্রেন সফরের আগে সাফ জানিয়ে দিয়েছে দেশটির সরকার।
রাশিয়ার সাথে প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত বাণিজ্যের পথে হাঁটলে ফল ভালো হবে না, এই হুঁশিয়ারি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সেই ‘ভারসাম্যের কূটনীতির’ পথ বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়েছে বলেই মনে করছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের একাংশ।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা