গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সবপর্যায়ের নেতৃবৃন্দ আত্মগোপনে রয়েছেন। খোদ দলটির প্রধান শেখ হাসিনা জন-অসন্তোষের রোষানল থেকে আত্মরক্ষায় পালিয়ে ভারতে গিয়ে উঠেছেন। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কোথায় রয়েছেন সে ব্যাপারে গতকাল পর্যন্ত সুনিদিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এশিয়া মহাদেশের বৃহৎ এ রাজনৈতিক দলটির বেহাল দশায় তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও চরমভাবে হতাশ হয়ে পড়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে দলটির স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা এবং নেতাকর্মীদের ধরে রাখতে শীর্ষ দু’টি পদে যোগ্য ও অভিজ্ঞদের মধ্য থেকে ‘ভারপ্রাপ্ত’ হিসেবে দায়িত্ব প্রদানের বিকল্প নেই বলে মনে করছেন রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়ামী লীগের শুভাকাক্সক্ষী মহল।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক গোলাম মাওলা রনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আওয়ামী লীগ তো এখন মৃত। যে গণরোষ তৈরি হয়েছে তাতে আওয়ামী লীগ আগামী ২০ বছরেও এই ধকল কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে মনে হয় না। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা এবং ওবায়দুল কাদেরকে দিয়ে আর রাজনীতি হবে না। উনাদের জায়গায় ভারপ্রাপ্ত দিয়ে যদি কিছু করা যায়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সবপর্যায়ের নেতাকর্মীরা বিপর্যস্ত ও হতাশার মধ্যে রয়েছেন। অনেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে গেলেও পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় তাও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে দলকে রাজনীতিমুখী হতে গেলে কাউকে দলটির হাল ধরতে হবে বলে মনে করেন উদারপন্থী শীর্ষ নেতাদের অংশটি। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্টের ঘটনায় দলের মহাবিপর্যয়ের পর কিভাবে দলের পুনর্গঠন করা যায়, কিভাবে জনসম্মুখে আসা যায় সেটি নিয়ে অনলাইনসহ ভিন্ন ভিন্ন প্লাটফর্মে শীর্ষ পর্যায়ে জোরালোভাবে আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। এর মধ্যে নতুন এবং পুরনো দিয়ে দল পুনর্গঠন নিয়ে ভাবছেন আওয়ামী লীগের উদারপন্থী নেতারা।
শেখ পরিবারের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেউই আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিতে আগ্রহী নন। অনেকেই মনে করছেন, দেশের এমন প্রেক্ষাপটে দায়িত্ব নিলে মামলা-হামলার বড় ধরনের ঝুঁকি রয়েছে। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর যে জনঅসন্তোষ তৈরি হয়েছে তাতে ঝুঁকি নিয়ে দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অনেক চ্যালেঞ্জ এবং কঠিন। অবশ্য বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সম্মতি দিলে যেসব নেতার নামে বর্তমান সময়ে মামলা নেই, ক্লিন ইমেজ ও গ্রহণযোগ্য তাদের মধ্য থেকে দায়িত্ব প্রদান করে দল পুনর্গঠন করার বিষয়টি চূড়ান্ত রূপ নিতে পারে। এই আলোচনায় রয়েছেন- আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন ও মো: রশিদুল আলম, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ, ডা: মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, ড. আব্দুর রাজ্জাক, লে. কর্নেল (অব:) ফারুক খান, সিমিন হোসেন রিমি ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ প্রমুখ।
অবশ্য গত ৬ সেপ্টেম্বর সাবেক রাষ্ট্রপতি ও আওয়ামী লীগের পোড় খাওয়া নেতা অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদকে আহ্বায়ক ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীকে সদস্যসচিব করে আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি গঠনের একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ওই বিবৃতিতে দলটির দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়–য়ার স্বাক্ষর দেখা যায়। যদিও ওই সময় দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়, আওয়ামী লীগকে বিভক্ত ও দুর্বল করার জন্য সামাজিক ও গণমাধ্যমে এ গুজব ছড়ানো হচ্ছে। নেতাকর্মীদের ফাঁদে পা না দেয়ার অনুরোধ জানানো হলো। দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এক বিবৃতিতে বলেন, একটি মহল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব পরিবর্তনের গুজব ছড়াচ্ছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ছিল, আছে, থাকবে ইনশা আল্লাহ।
এ প্রসঙ্গে ১৪ দলের অন্যতম শরিক ন্যাপের সহ-সম্পাদক ও বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক মো: ইসমাইল হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল টানা ১৫ বছরেরও বেশি ক্ষমতায় ছিল। হঠাৎ করে এক মহাবিপর্যয় ঘটেছে এবং দলের সবপর্যায়ের নেতৃবৃন্দ আত্মগোপনে রয়েছেন- এটা ইতিহাসে বিরল। তিনি বলেন, এত বড় একটি দল এভাবে না থেকে খুব শিগগিরই পুনর্গঠন করা জরুরি। নেতাকর্মীদের সক্রিয় করা এবং রাজনীতিতে অংশগ্রহণ রাখার জন্য আপাতত বিতর্কিত নয়, সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য এমন নেতাদের মধ্য থেকে কাউকে দায়িত্ব দিয়ে দল রিফর্ম করা যেতে পারে। পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনাসহ অন্য নেতারা মামলা ফেস করে যদি দেশে ফিরতে পারেন তখন তারা আবার দায়িত্ব নেবেন- এতে দোষের কিছু থাকবে না।