গাইবান্ধা জেলার মোল্লার চর এলাকার বাসিন্দা হুমায়ূন কবীর (৪৯)। বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। হঠাত্ই তিনি হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লে চিকিত্সক জানান, তার দ্রুত ওপেনহার্ট সার্জারি করতে হবে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে বাঁচাতে আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার-দেনা করে ৩ লাখ টাকা জোগাড় করে স্ত্রী তার চিকিত্সায় ব্যয় করেন। এখন হুমায়ূন কবীর সুস্থ হলেও তার দীর্ঘমেয়াদি এই চিকিত্সার ব্যয় এবং ধারের টাকা শোধ করতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাদের বড় মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়েছে, স্ত্রীকে কাপড় সেলাইয়ের কাজ করতে হচ্ছে এবং ছোট ছেলেটা কোনোরকমে টিউশনি করে তার পড়ার খরচ চালাতে বাধ্য হচ্ছে।
এমন অবস্থা শুধু হুমায়ূন কবীরের নয়; প্রতিদিন দেশের অসংখ্য ব্যক্তি সাধ্যের বাইরে চিকিত্সা ব্যয় বহন করতে গিয়ে এমন পরিস্থিতিতে পড়ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুয়ায়ী, চিকিত্সা ব্যয় মেটাতে গিয়ে দেশে প্রতিবছর ৩ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ দরিদ্র হচ্ছে। ১৫ শতাংশ পরিবার অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা (ইউনিভার্সেল হেলথ কভারেজ) বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও বিশ্ব ব্যাংকের এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাস্থ্য ব্যয়ের এ চাপে চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৫১ শতাংশ মানুষ। মাথাপিছু দৈনিক ১ দশমিক ৯ ডলার আয়ের হিসাবে এ তথ্য দিয়েছে ডব্লিউএইচও ও বিশ্বব্যাংক। আর দৈনিক আয় যাদের ৩ দশমিক ১ ডলার, অতিরিক্ত স্বাস্থ্য ব্যয়ের কারণে দারিদ্র্যের কবলে পড়ছে তাদের ৪ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ব্যয় দিনকে দিন বাড়ছে। বর্তমানে দেশের ৪০ ভাগ মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা হলেও ৫০ ভাগ মানুষ এখনো ভালোমানের স্বাস্থ্যসেবা পায় না। অথচ সবার জন্য সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ১৭টি উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্যতম।
গতবছর ১৩ ডিসেম্বর প্রকাশিত ‘ট্র্যাকিং ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ :২০১৭ গ্লোবাল মনিটরিং প্রতিবেদনে’ বলা হয়েছে— জীবনযাত্রার মান নির্বিশেষে প্রত্যেকেই প্রয়োজন অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবা পাবে। আর এ স্বাস্থ্যসেবা পেতে গিয়ে আর্থিক দীনতায় পড়তে হবে না কাউকেই। ইউএইচসির ঘোষণায় এমনটি বলা হলেও বাংলাদেশে অনেক মানুষকে আর্থিক বিপর্যয়ে পড়তে হচ্ছে অতিরিক্ত স্বাস্থ্য ব্যয়ের কারণে।
সর্বশেষ ২০১৫ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্ট’ (এএনএইচএ) এর তথ্যে জানা যায়, স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে জনপ্রতি ১০০ টাকার মধ্যে ৬৭ টাকাই মানুষের পকেট থেকে ব্যয় করতে হচ্ছে। ২০১২ সালে যা ছিল ৬৩ টাকা। সরকার জনপ্রতি ২৩ টাকা, দাতা সংস্থাগুলো ৭ টাকা ও অন্যান্য সংস্থা ৩ টাকা ব্যয় করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাইবান্ধা বা পঞ্চগড় থেকে কোনো রোগী এসে সহজে বিএসএমএমইউ’তে কিংবা মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে চিকিত্সা নিতে পারেন না, কারণ আমাদের দেশে রেফারেল সিস্টেম ভালো নয়। অন্যদিকে উপজেলা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কার্যকর না থাকা, চিকিত্সকদের ইচ্ছামাফিক ফি নির্ধারণ, অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধের দাম বৃদ্ধি, দালালদের অপতত্পরতা—এসব বিভিন্ন কারণে বাড়ছে চিকিত্সা ব্যয়। চিকিত্সা ব্যয় বাড়ায় অতিদরিদ্র মানুষ চিকিত্সাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আর চিকিত্সা ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতিবছর প্রায় ৬৪ লাখ মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক ইত্তেফাককে বলেন, আমাদের চিকিত্সার জন্য ৬৩ থেকে ৬৪ টাকা নিজের পকেট থেকে ব্যয় করতে হয়। আর সরকারের যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আছে এবং আমাদের যে বাজেট আছে এটা অত্যন্ত অপ্রতুল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ধারণায় ২০৩০ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে ও সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুসারে নিজের পকেট থেকে চিকিত্সা ব্যয় ৩০ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনতে পারলে তা সহনীয় পর্যায়ে আসবে। এর জন্য বীমা পলিসি সহায়তা করতে পারে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য এবং স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব ইত্তেফাককে বলেন, দরিদ্ররা পয়সা দিয়ে সেবা কিনতে গিয়ে গরিব হয়ে যাচ্ছে। এই দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে।