পারকিনসন্স রোগটি সম্পর্কে স্বচ্ছ একটি ধারণা নেয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ তো দূরে থাক, চিকিত্সগণও অনেক ক্ষেত্রে নানা ধরণের বিভ্রান্তিতে ভোগেন। তারপর চিকিত্সা তো আরও অনেক জটিল। তবে এই রোগটি নিশ্চিত করার সহজ উপায় হল প্রায় সবক্ষেত্রেই রোগীর হাটাচলার গতি কমে যায় আর কোন কাজ করতে গেলেই হাত/পা কাঁপতে থাকে। রোগীর বসা থেকে উঠা, হাটা, ঘোরাসহ দৈনন্দিন যাবতীয় কাজই আস্তে আস্তে খুব স্লো হয়ে যায়। রোগটি বাড়তে থাকলে রোগী সামনের দিকে ঝুঁকে হাটা চলা শুরু করে এবং সেক্ষেত্রে সামনের দিকে পরে যাবার উপক্রম হলে ভারসাম্য রক্ষার জন্য রোগী একটু দৌড়ানোর মত করে হাঁটে। এরপর কথাবার্তায় জড়তা, প্রস্রাব-পায়খানার নিয়ন্ত্রণহীনতা, যৌন দুর্বলতাসহ নানা রকম উপসর্গ দেখা দেয়।
লিভোডোপা নামের ওষুধটি সারা বিশ্বে এই রোগের সবচেয়ে কার্যকর ও প্রায় একমাত্র ওষুধ হিসেবে এখনও পর্যন্ত বিবেচিত। প্রথমদিকে এই ওষুধটি সেবনে খুবই ভাল ফল পাওয়া যায়। কিন্তু দুই থেকে চার বছরের ভেতর এই ওষুধটির কার্যকারিতা কমতে থাকে এবং সেই সাথে মারাত্মক সব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। পরবর্তীতে রোগটির অ্যাডভান্সড ষ্টেজে ওষুধ না খেলে রোগী হাঁটা-চলার ক্ষমতা সম্পূর্ণ হারিয়ে প্রায় জড় পদার্থে পরিণত হয়। আর ওষুধ খেলে রোগী অনিয়ন্ত্রিতভাবে হাত-পা ছুড়তে থাকে। সেক্ষেত্রে রোগীটি হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর রকম সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যার কারণ। পারকিনসন্স সাধারণত পঞ্চাশ বছর বয়সের পরের রোগ। পুরুষদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
যেহেতু রোগটি নিরাময়যোগ্য না-শুধুমাত্র রোগটির গতিবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে ভাল থাকার সময়টাকে বাড়িয়ে দেওয়া যায়, তাই এই রোগের আধুনিক চিকিত্সা পদ্ধতি হল ওষুধের কার্যকারিতা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই একটি অত্যাধুনিক অপারেশনের ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা শুরু করা। এই অপারেশনের প্রিন্সিপ্যাল হল ডোপামিনের কাজটি একটি বিকল্প বিদ্যুৎ সার্কিটের মাধ্যমে নিয়ে যাওয়া। এবং ওষুধের কার্যকারিতা শেষ হওয়ার সাথে সাথে যত দ্রুত অপারেশনটি করা যায় ততই রোগীর পরবর্তীতে ভাল থাকার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে। তবে অপারেশনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ একটি শ্রমসাধ্য ও জটিল প্রক্রিয়া।
ফাংশনাল নিউরোসার্জন, মুভমেন্ট ডিসঅর্ডার নিউরোলজিস্ট ও নিউরোসাইকিয়াট্রিস্ট সমন্বয়ে গঠিত একটি টীমকে রোগী পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এই রোগের সাথে যদি স্মৃতিভ্রষ্টতা, খুব আস্তে আস্তে কথা বলা ইত্যাদি সমস্যাগুলো থাকে তবে অপারেশনটি বাদ দেওয়া হয় কারণ এতে রোগী সম্পূর্ণ বাকশক্তিহীন ও স্মৃতিহীন হয়ে যেতে পারে। ব্রেনের আরও কিছু কাছাকাছি জটিল রোগের সাথে এই পারকিনসন্স রোগটির মিল থাকার কারণেও ক্ষেত্রে বিশেষে সিদ্ধান্ত গ্রহণে জটিলতার সৃষ্টি হয়ে থাকে।
মূল অপারেশনের আগে নিউরোসার্জনদের একটি জটিল প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আগাতে হয়। প্রথমে একটি বিশেষ প্রটোকলে রোগীর একটি হাই রেজুলেশন এমআরআই করা হয় যাতে ব্রেনের নিউক্লিয়াসগুলো স্পষ্টভাবে বুঝা যায়। যেই নিউক্লিয়াসগুলির ভেতর একটি নির্দিষ্ট নিউক্লয়াসে (সাব থ্যালামিক নিউক্লয়াস) ডিবিএস ইলেকট্রোডগুলি বসানো হয়। তারপর রোগীর মাথায় একটি বিশেষ ধরণের স্টেরিয়েটেকটিক ফ্রেম বসিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে একটি সিটি স্ক্যান করা হয়। এরপর এই সিটি স্ক্যান ও আগের করা এমআরআই-এর ছবি কম্পিউটারে নিয়ে ডিজিটালি ফিউজ করে এক করা হয়। তারপর একটি নেভিগেশন সফটওয়্যার ব্যবহার করে মগজের কোন জায়গায় ইলেকট্রোডটি স্থাপন করা হবে তার দৈর্ঘ্য-প্রস্ত ও উচ্চতাসহ একটি ত্রিমাত্রিক দিক ঠিক করা হয়।
যথাযথভাবে অপারেশন করা গেলে এবং প্রয়োজনীয় ডিভাইস স্থাপন করা গেলে এই অপারেশনের পর পারকিনসন্স রোগটি সর্বোচ্চ বিশ বছর পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারে।
বাংলাদেশে এই অপারেশনের ধারণাটা একেবারেই নতুন। প্রফেসর টিপু আজিজের নেতৃত্বে দক্ষ একদল নিউরোসাইন্টিস্ট এই রোগটির অপারেশন বাংলাদেশের জনগণের কাছে পরিচিত ও সহজলভ্য করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে এই অপারেশনটার প্রধানতম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে যে এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তবে বাংলাদেশে পারকিনসন্স রোগীর অপারেশন নিয়মিত করা গেলে এ ধরণের ব্যয় হ্রাস করা সম্ভব হবে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, নিউরো সার্জারি ও ফাংশনাল নিউরো সার্জন, ডিএইচএস, ঢাকা।