বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তিতে অটোমেশন পদ্ধতি চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকরা। তারা মনে করেন, অটোমেশন পদ্ধতি একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এটা মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।
এছাড়া দেশের সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমানে ৬৬টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১০ হাজারের বেশি বিদেশি অধ্যয়নরত। যাদের কাছ থেকে সরকার বছরে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। তাহলে কেন সরকারের শেষ সময়ে এই ধরনের সিদ্ধান্ত? এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।
এদিকে ভারতীয় দূতাবাসের এডুকেশন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১২ হাজার নতুন বিদেশি শিক্ষার্থী এদেশে ভর্তি হচ্ছেন। এর সিংহভাগই ভারত ও নেপালের। এর মধ্যে বেশির ভাগই মেডিকেল শিক্ষার্থী। নেপালের ৯০ শতাংশ চিকিৎসকের সার্টিফিকেট বাংলাদেশের।
সারা বিশ্বে সরকার বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষাকে সহজতর করেছে। যাতে করে বেসরকারি খাত চিকিৎসা শিক্ষায় এগিয়ে আসে। বাংলাদেশে সরকারি চিকিৎসা শিক্ষায় যে ব্যবস্থাপনা তা চাহিদার তুলনায় সীমিত। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো চিকিৎসা শিক্ষায় বড় অবদান রাখছে। সেখানে এই পরিবেশে বিদেশি শিক্ষার্থীরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস কোর্সে আফগানিস্তানসহ সার্কভুক্ত দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য ১০৪টি আসন রয়েছে। সরকারি ডেন্টাল (বিডিএস) কলেজে রয়েছে ১৩টি আসন। সার্কের বাইরের দেশের নাগরিকদের সরকারিতে এমবিবিএস কোর্সে ৭২টি এবং বিডিএস কোর্সে ২৭টি আসন রয়েছে।
এই ঊর্ধ্বমুখী ধারায় অধিদপ্তর ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে সরকারিতে এমবিবিএস কোর্সে ১১৫ জনের অনুমোদন দেয়ার পর ৯৬ জন ভর্তি হয়েছিলেন। এর মধ্যে সার্কভুক্ত দেশের শিক্ষার্থী ছিলেন ৭৬ জন। ডেন্টালে ভর্তি হওয়া ছয়জনের মধ্যে সার্কভুক্ত ছিলেন চারজন। বেসরকারিতে এমবিবিএস কোর্সে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ১৪২৭ জন এবং ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ১৭৩৭ জন ভর্তি হন। এছাড়া ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ১৯৭০ জন ভর্তি হন।
সূত্র আরও জানায়, ২০১১ সালে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির হার ২৫ শতাংশ ছিল। পর্যায়ক্রমে এই হার বাড়ছে। গত বছর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মেডিকেল কলেজগুলোয় ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করা যাবে বলে নির্দেশনা দিয়েছে। এমনকি মিয়ানমারের শিক্ষার্থীদের জন্য এমবিবিএসে ৫টি এবং বিডিএসে ২টি আসন বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
এমন সময় হঠাৎ করে অটোমেশন পদ্ধতির জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, এটা মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। এতে ক্ষুণ্ন হবে দেশের ভাবমূর্তি।
যেখানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে কেনাকাটায় দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ বিদ্যমান, সেখানে বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষায় ভর্তির বিষয়টি সরাসরি তাদের হাতে নিয়ে যাওয়া একটি ষড়যন্ত্রের অংশ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরকারের শেষ সময়ে এই ধরনের সিদ্ধান্ত কেন? বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে বিদেশি শিক্ষার্থীদের এই পরিবেশকে পছন্দ হবে না। তারা অন্য দেশে চলে যেতে পারে। এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নিয়ে তখন প্রশ্ন উঠবে।
মেডিকেলে ভর্তির ক্ষেত্রে সরকারের ঘোষিত একটি নীতিমালা রয়েছে। সেই নীতিমালা অনুযায়ী প্রত্যেকটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি কমিটি রয়েছে। সেই কমিটিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডিন ও সংশ্লিষ্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ থাকেন।
এমন একটি শক্তিশালী ভর্তি কমিটি থাকতে সেখানে হঠাৎ করে অটোমেশন পদ্ধতি কেন চালু করা হচ্ছে? এ নিয়ে অনেকেরেই প্রশ্ন। কারণ, এই কমিটি তো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গঠিত। কেউ অনিয়ম করলে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে। অতীতে ব্যবস্থা নেয়াও হয়েছে।
দেশে প্রথম বারের মতো বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তিতে অটোমেশন পদ্ধতি চালু করার সিদ্ধান্ততে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকরা।
তারা বলেন, অটোমেশন পদ্ধতি একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। অটোমেশন নয়, প্রচলিত নীতিমালাই সঠিক। যারা ঢাকার বাইরে থাকেন, তারা যদি অটোমেশনে ঢাকায় ভর্তির সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে থাকা-খাওয়ার বাড়তি খরচ জোগাড় করতে হয় অভিভাবকদের। অন্যদিকে যিনি ঢাকা থেকে বাইরে যাবেন, তাকেও একই হয়রানির শিকার হতে হবে। তাই প্রচলিত পদ্ধতিতে ভর্তি হলে হয়রানি ও আর্থিক ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবেন উভয়ই।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা বলেন, প্রচলিত নীতিমালা অনুযায়ী ভর্তিতে অনিয়ম হলে অবশ্যই ধরা পড়বে। তখন সঠিকভাবে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারবে অধিদপ্তর। নিয়েছেও তারা। সরকারের নীতিমালা থাকতে অটোমেশন পদ্ধতি চালু করার অর্থ হলো, বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষায় একটি অসন্তোষ সৃষ্টি করা। ফলে অত্যন্ত ব্যয়বহুল মেডিকেল শিক্ষাকে অপেক্ষাকৃত কম ব্যয়বহুল সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে মিশিয়ে অটোমেশনের আওতায় আনলে ব্যয়বহুল বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়া অনিবার্য। তাই নিজেদের ব্যর্থতা অন্যদের ওপরে চাপানো উচিত নয়।
তারা আরও বলেন, দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। দেশের বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলো চিকিৎসা শিক্ষা ও সেবায় বড় অবদান রাখছে। যার বড় প্রমাণ মহামারি করোনার সময়ও বড় সাপোর্ট দেয়া। করোনা মোকাবিলায় সফল হওয়ার নেপথ্যের কারিগর বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। একটি চক্র চাচ্ছে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো রাস্তায় নেমে আসুক। সরকারের শেষ সময়ে এসে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার ষড়যন্ত্র হিসেবে অটোমেশন পদ্ধতি চালু করতে যাচ্ছে মহলটি। তাই আগের ভর্তি পদ্ধতি বহাল রাখার দাবি জানিয়েছেন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশে বিদেশি শিক্ষার্থীদের মেডিকেল শিক্ষায় ভর্তির আগ্রহ কেন বেশি—এই প্রসঙ্গে তারা বলেন, বাংলাদেশের মেডিকেল শিক্ষায় বেসরকারিতে অবকাঠামোগত কিছু দুর্বলতা থাকলেও পড়াশোনার মান ভালো। শিক্ষার্থীরা এখান থেকে পাশ করে নিজের দেশের এন্ট্রি পরীক্ষায় রাশিয়া, চীন ও অন্যান্য দেশ থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের তুলনায় ভালো ফল করছেন। এবং বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোয় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগী বেশি থাকায় শিক্ষার্থীদের হাতেকলমে শেখার সুযোগ বেশি। রোগের ধরন অনুযায়ী একাধিক বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল গড়ে ওঠায় শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত শিখতে পারছেন। বর্তমানে পাঁচটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি একাধিক মেডিকেল ইনস্টিটিউটে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের সুযোগ রয়েছে। উন্নত দেশের তুলনায় এখানে পড়াশোনা ও জীবনযাত্রার ব্যয় কম।