দিমিত্রি মিশভের পাসপোর্ট
রুশ সামরিক বাহিনীর একজন বৈমানিক লেফটেন্যান্ট দিমিত্রি মিশভ পায়ে হেঁটে রাশিয়া ছেড়ে পালিয়ে লিথুয়ানিয়ায় এসে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন।
বিবিসিকে দেয়া এক বিরল সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেছেন- ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যাপক প্রাণহানি আর মনোবল কমে যাওয়ার কারণে রুশ বাহিনী এখন কতটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
দিমিত্রি মিশভের বয়স ২৬। রুশ বাহিনীতে তিনি হচ্ছেন একজন ‘অ্যাটাক হেলিকপ্টার নেভিগেটর’। তিনি বলেন, রাশিয়া ছেড়ে পালানো ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না।
পিঠে একটি ছোট রাকস্যাক ঝুলিয়ে, নাটকীয়ভাবে পায়ে হেঁটে সীমান্ত পেরিয়ে লিথুয়ানিয়ায় ঢুকে সেখানকার কর্তৃপক্ষের হাতে আত্মসমর্পণ করে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন তিনি।
রুশ বাহিনীতে কর্মরত আরো কিছু সামরিক কর্মকর্তা এভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, ইউক্রেনে গিয়ে যুদ্ধ করা এড়াতে।
তবে বিবিসির জানামতে, বৈমানিকদের মধ্যে দিমিত্রিই প্রথম। অনেকদিন ধরেই পালানোর পথ খুঁজছিলেন তিনি
দিমিত্রিকে মোতায়েন করা হয়েছিল উত্তর-পশ্চিম রাশিয়ার পিসকভ অঞ্চলে। যখন তার হেলিকপ্টারটিকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হতে লাগলো, তখনই তিনি বুঝতে পারলেন যে এটা কোনো মহড়া বা ড্রিল নয় – এবার আসল যুদ্ধ আসছে।
তিনি প্রথমবার বিমানবাহিনী ত্যাগ করার চেষ্টা করেন ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে। কিন্তু রাশিয়া যখন সে বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে অভিযান চালায়, তখনো দিমিত্রির কাগজপত্র প্রস্তুত হয়নি।
সেবার তাকে পাঠানো হলো বেলারুসে, তার কাজ ছিল হেলিকপ্টার চালিয়ে সামরিক সরঞ্জাম বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দেয়া।
দিমিত্রি বলেন, তিনি কখনো ইউক্রেনে যাননি। তার বর্ণনা করা কাহিনী যাচাই করার কোনো উপায় নেই। তবে তার সাথে থাকা দলিলপত্র আসল বলেই মনে হয়, এবং তার বিবৃতির অনেক অংশই অন্য সূত্র থেকে জানা আমাদের তথ্যের সাথে মিলে যায়।
সামরিক বাহিনী ছাড়তে দেয়া হলো না দিমিত্রিকে
দিমিত্রি রাশিয়ায় তার মূল ঘাঁটিতে ফিরে আসেন ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে। তিনি মনে করেছিলেন, সেখানে থাকতে থাকতেই তার ডিকমিশনিং অর্থাৎ সামরিক বাহিনী থেকে ছাড়া পাওয়ার কাগজপত্র তৈরি হয়ে যাবে।
কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট পুতিন ঘোষণা করলেন, রুশ বাহিনীতে আরো সৈন্য সমাবেশের কথা।
দিমিত্রিকে বলা হলো, তাকে এখন সামরিক বাহিনী ত্যাগ করতে দেয়া হবে না।
তিনি জানতেন, কোনো না কোনো সময় তাকে ইউক্রেনে পাঠানো হবেই। তাই আগে থেকেই তিনি রাস্তা খুঁজছিলেন কিভাবে তা এড়ানো যায়।
‘আমি একজন সামরিক অফিসার। আমার কর্তব্য হলো দেশকে আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করা। আমি একটি অপরাধের সহযোগী হতে বাধ্য নই। কেউ আমার কাছে ব্যাখ্যা করেনি যে কেন এ যুদ্ধ শুরু হলো, কেন আমাকে ইউক্রেনীয়দের আক্রমণ করতে হবে, কেন তাদের শহরগুলোকে ধ্বংস করতে হবে।’
বেতন নিয়ে অসন্তুষ্ট রুশ সৈন্যরা
দিমিত্রি বর্ণনা করছেন, সামরিক বাহিনীর ভেতরের মনোভাবকে বলা যায় মিশ্র।
কিছু লোক আছে যারা যুদ্ধকে সমর্থন করে আবার অন্য কিছু আছে যারা তীব্রভাবে এর বিরোধী। খুব কম সৈনিকই বিশ্বাস করে যে তারা আসলেই কোনো বিপদ থেকে রাশিয়াকে রক্ষার জন্য যুদ্ধ করছে।
যদিও অনেকদিন ধরেই রাশিয়ার সরকারি ভাষ্য হচ্ছে এটাই – রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটি আক্রমণ ঠেকানোর জন্য মস্কো ‘বিশেষ সামরিক অপারেশন’ চালাতে বাধ্য হয়েছে।
দিমিত্রি মিশভের মতে, সেনাবাহিনীতে সবচেয়ে জোরালো যে অনুভূতি তা হচ্ছে নিম্ন বেতনকে কেন্দ্র করে অসন্তোষ।
তিনি বলেন, বিমান বাহিনীর অভিজ্ঞ কর্মকর্তারাও বেতন পাচ্ছেন যুদ্ধের আগেকার চুক্তি অনুযায়ী ৯০ হাজার রুবল (১,০৯০ মার্কিন ডলার)। অন্যদিকে নতুন রিক্রুটদেরকে সেনাবাহিনীতে নেয়া হয়েছে ২ লাখ ৪ হাজার রুবল (১,৯৬০ ডলার) বেতনের লোভ দেখিয়ে। প্রকাশ্যভাবে প্রচারিত সরকারি বিজ্ঞাপনে এ কথাই বলা হয়েছে।
সেনাবাহিনীর কেউই ‘যুদ্ধের সরকারি খবর’ বিশ্বাস করে না
দিমিত্রি বলছেন, ইউক্রেনের ব্যাপারে নানা জনের নানা রকম মনোভাব আছে, কিন্তু সরকারি খবরে ‘যুদ্ধ ভালোভাবে চলছে’ বা ‘নিম্ন প্রাণহানি’র যেসব কথা বলা হচ্ছে – তা সেনাবাহিনীর কেউই বিশ্বাস করে না।
‘সামরিক বাহিনীতে কেউই কর্তৃপক্ষকে বিশ্বাস করে না। তারা দেখতে পাচ্ছে যে আসলে কী ঘটছে। তারা তো আর টেলিভিশনের সামনে বসে থাকা বেসামরিক লোক নয়। সামরিক বাহিনীর লোকেরা সরকারি খবর বিশ্বাস করে না, কারণ একটাই – এগুলো সত্যি নয়।’
তিনি বলেন, যুদ্ধের প্রথম দিকে রুশ কমান্ড দাবি করছিল যে কেউ হতাহত হয়নি বা কোনো সরঞ্জাম ধ্বংস হয়নি, কিন্তু তিনি ব্যক্তিগতভাবে জানতেন এরকম কয়েকজন যুদ্ধে নিহত হয়েছে।
যুদ্ধের আগে তার নিজের ইউনিটে ৪০ থেকে ৫০টি বিমান ছিল। ইউক্রেনে রুশ অভিযান শুরু হবার পর প্রথম কয়েক দিনে তার ছয়টিকে গুলি করে ভূপাতিত করা হয়, আর তিনটি ধ্বংস হয় মাটিতে থাকা অবস্থাতেই।
রুশ কর্তৃপক্ষ খুব কম সময়ই সামরিক বাহিনীতে নিহতের খবর দেয়। গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু বলেন, রাশিয়া ৬ হাজার সৈন্য হারিয়েছে। বেশিরভাগ বিশ্লেষক, এমনকি ক্রেমলিন সমর্থক সামরিক ব্লগাররাও মনে করেন যে এ সংখ্যা কম করে দেখানো হচ্ছে।
বিবিসি রাশিয়ানের ওলগা ইভশিনা এমন একটি গবেষণা প্রকল্পের সাথে আছেন যারা ইউক্রেন যুদ্ধে নিহত রুশ সৈন্যদের চিহ্নিত করে। তিনি প্রকল্পের সবশেষ তথ্যে বলেছেন, তিনি বিভিন্ন র্যাংকের ২৫ হাজার রুশ সৈন্যের নামের তালিকা তৈরি করেছেন। তিনি ধারণা করেন যে নিখোঁজ সৈন্যসহ প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে।
দিমিত্রি বলছেন, সামরিক বিমানের ক্রুদের মধ্যে নিহতের সংখ্যা অত্যন্ত বেশি।
ওলগা ইভশিনার একটি অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যের সাথে তার কথা মিলে যায়। তাতে দেখা গেছে, রাশিয়া পাইলট ও টেকনিশিয়ানসহ শত শত উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন লোকদের হারিয়েছে – যাদের প্রশিক্ষণ সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল।
‘এখন তারা নতুন হেলিকপ্টার আনতে পারবে, কিন্তু পাইলট যথেষ্ট নেই। আমরা যদি ১৯৮০’র দশকের আফগানিস্তান যুদ্ধের সাথে এর তুলনা করি তাহলে দেখা যায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন সেখানে ৩৩৩ জন পাইলট হারিয়েছিল। আমার ধারণা এক বছরেই আমাদের একই পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।’
কিভাবে পালালেন দিমিত্রি
দিমিত্রিকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে বলা হলো, তাকে একটি মিশনে পাঠানো হচ্ছে।
তিনি বুঝলেন এটার মাত্র একটিই অর্থ হয় – তার তা হলো ইউক্রেন।
দিমিত্রি তখন আত্মহত্যা করার চেষ্টা করলেন। তার আশা ছিল এর ফলে তাকে স্বাস্থ্যগত কারণে সামরিক বাহিনী থেকে ছাড়িয়ে দেয়া হবে। কিন্তু তা হলো না।
হাসপাতালে যখন তিনি সেরে উঠছেন, তখন তিনি একটা নিবন্ধ পড়লেন। তাতে বলা হয়েছিল, পিসকভ অঞ্চলের একজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা লাটভিয়া পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। দিমিত্রি ঠিক করলেন, তিনিও এ পথই অনুসরণ করবেন।
‘আমি আসলে ঠিক সেনাবাহিনীতে কাজ করতে অস্বীকার করছিলাম না। আমার দেশ যদি প্রকৃতই কোনো হুমকির মুখে পড়ে তাহলে আমি তার জন্য লড়বো, কিন্তু আমি একটা অপরাধের ভাগীদার হতে অস্বীকার করছিলাম।’
‘আমি যদি ওই হেলিকপ্টারে উঠতাম, তাহলে আমি হয়তো অন্তত বেশ কয়েক ডজন লোকের প্রাণ হরণ করতাম। আমি সেটা করতে চাইনি। ইউক্রেনীয়রা আমার শত্রু নয়।’
টেলিগ্রামে কিছু চ্যানেলে সহায়তার জন্য খোঁজখবর নিলেন দিমিত্রি ।
তিনি পরিকল্পনা করলেন, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সীমান্ত পার হবেন। দিমিত্রি যথাসম্ভব হালকা জিনিসপত্র ভরে ব্যাগ গোছালেন।
‘ওরা যদি আমাকে ধরতে পারতো তাহলে আমার অনেক দিনের জন্য জেলে থাকতে হতো।’
তিনি বলেন, এক পর্যায়ে তার কাছেই কোথাও পর পর দুটো ফ্লেয়ার (জঙ্গল আলোকিত করার জন্য উড়ন্ত আতশবাজি) ছোঁড়া হলো।
আতঙ্কিত হয়ে তিনি ভাবলেন, সীমান্ত প্রহরীরা হয়তো তার পিছু ধাওয়া করছে। তিনি দৌড়াতে শুরু করলেন।
‘আমি কোথায় যাচ্ছি কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমার তখন মাথায় সব এলোমেলো হয়ে গেছে।’
তিনি একটা কাঁটাতারের বেড়া দেখতে পেলেন, এবং তা টপকালেন। কিছুক্ষণ পরই তিনি বুঝতে পারলেন যে তিনি সীমান্ত পেরোতে পেরেছেন।
‘শেষ পর্যন্ত আমি মুক্তভাবে শ্বাস নিতে পারলাম।’
দিমিত্রি এখন কী করতে চান
দিমিত্রির ধারণা, রাশিয়ার কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা শুরু করবে। তবে তার বিশ্বাস, সেনাবাহিনীতে তার কমরেডদের অনেকেই বুঝতে পারবে যে কেন তিনি এ কাজ করেছেন।
কেউ কেউ তাকে পরামর্শ দিয়েছিল রাশিয়ার ভেতরেই কোথাও লুকিয়ে থাকার জন্য।
কিন্তু তিনি মনে করেন, রাশিয়ার মতো অত বড় দেশেও শেষ পর্যন্ত তিনি ধরা পড়া এবং সেনাবাহিনী ত্যাগের জন্য শাস্তি থেকে রেহাই পেতেন না।
দিমিত্রি এখনো জানেন না তার ভাগ্যে এর পর কি ঘটতে যাচ্ছে।
তবে তিনি বলেন, তার ইচ্ছা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নেই থেকে যাওয়া এবং সেখানে নতুন জীবন গড়ে তোলার চেষ্টা করা।