ছোটবেলায় যখন ভূগোল কিংবা বিজ্ঞানের বইগুলো পড়তাম, মনে পড়ে সেখানে কিছু গ্রহ-নক্ষত্রের ছবি থাকত। অ্যাস্ট্রনমি বিষয়ের ওপর একটা ভালো লাগা সেই তখন থেকেই ছিল। তাই বেশ আগ্রহ নিয়ে ছবিগুলো খেয়াল করতাম। হঠাৎ করেই একটি গ্রহের ছবি আমার কিছুটা অন্যরকম লেগেছিল। কারণটা হলো, তার ছবিটা আর দশটি গ্রহ থেকে বেশ আলাদা। গ্রহটি হলো স্যাটার্ন বা শনি গ্রহ।
যদি এই গ্রহটিকে আমরা সূর্যের সাপেক্ষে দূরত্বের হিসাব করি, তা হলে শনি সৌরজগতের ষষ্ঠ গ্রহ হিসেবে বিবেচিত হবে। আবার যদি আকারের হিসাব করা হয়, তা হলে এটি বৃহস্পতির পরই সৌরজগতের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রহ। এটি একটি গ্যাসীয় দানব, যার ব্যাসার্ধ পৃথিবীর ব্যাসার্ধের প্রায় ৯ গুণ।
গ্রহটিকে আমার অন্যান্য গ্রহ থেকে আলাদা লাগার একটাই কারণ। এর চারপাশে অনেক রিং বা বলয় রয়েছে, যা তাকে বাহ্যিকভাবে আর দশটা গ্রহ থেকে আলাদা করেছে।
শনি গ্রহকে চারদিক থেকে যে বলয় ঘিরে রেখেছে, সেটি শনিকে গ্রহ মণ্ডলে এক নিজস্বতা দিয়েছে।
দূর থেকে আদতে একে দেখতে বলয় মনে হলেও আসলে বলয়টি কিন্তু ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ খণ্ড খণ্ড পাথরের ঘূর্ণায়মান অবস্থা। শনির মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে বলয় আকারে কোটি কোটি পাথরখণ্ড ঘুরে চলেছে অবিরাম, কয়েক বিলিয়ন বছর ধরে।
যে কারণে গ্রহটির চারপাশে এমন বলয়ের মতো গাঠনিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।
জীবন সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোর সন্ধান হয়তো মিলতে পারে শনি গ্রহের সবচেয়ে বড় চাঁদ টাইটানে। এ বিষয়ে অনুসন্ধান করার জন্য নাসা সম্প্রতি মহাকাশে ড্রোন পাঠিয়েছে। বিজ্ঞানীরা নাসার পাঠানো সেই ড্রোনের পর্যবেক্ষণের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছেন। তাদের ধারণা, যেকোনো গ্রহ কিংবা নক্ষত্রে প্রাণের অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এই ড্রাগনফ্লাই রোটারক্র্যাফ্ট ল্যান্ডারটি হবে নাসার সব থেকে
পারদর্শী মহাকাশযান।
ড্রাগনফ্লাই হলো নাসার প্রথম ইন্টারপ্ল্যানেটারি রোটারক্র্যাফ্ট-ল্যান্ডার প্রোব, যা বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির একটি সম্পূর্ণ স্যুট দিয়ে সজ্জিত। এটি নাসার নিউ ফ্রন্টিয়ার্স প্রোগ্রামের অংশ। নাসার এই ড্রোন টাইটানের পৃষ্ঠে বেশ কয়েক মাইল পর্যন্ত উড়তে সক্ষম।
বর্তমানে মেরিল্যান্ডের লরেলের জনস হপকিন্স অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্স ল্যাবরেটরিতে এই ড্রোনের ডিজাইন ও নির্মাণকাজ চলছে।
২০২৭ সাল নাগাদ হয়তো মহাবিশ্বে জীবনের অনুসন্ধানে যে অভিযান শুরু হয়েছে, সে বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলতে পারে। এই মুহূর্তে নাসার ড্রাগনফ্লাই ড্রোনটি শনির বৃহত্তম চাঁদ টাইটানে পাঠানোর কাজ এগিয়ে চলেছে। টাইটানে জীবন সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোর কোনো অস্তিত্ব রয়েছে কি না, সে বিষয়ে অনুসন্ধান চালাবে এই ড্রোন।
নাসার বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে জানতে পেরেছেন, শনির বৃহত্তম চাঁদ টাইটানে রয়েছে নাইট্রোজেন গ্যাসসমৃদ্ধ বায়ুমণ্ডল। এ ছাড়া এখানে ভূগর্ভস্থ তরল পানির মহাসাগরও থাকবার সম্ভাবনা রয়েছে।
শনির বৃহত্তম চাঁদটিকে মনে করা হচ্ছে, সৌরজগতের দ্বিতীয় বৃহত্তম চাঁদ। আকারের দিক থেকে বৃহস্পতি গ্রহের চাঁদ গ্যানিমিডের ঠিক পরেই থাকবে টাইটানের অবস্থান। এ ছাড়া শনির চাঁদ টাইটান আকারের সৌরজগতের অন্যতম গ্রহ বুধ-এর থেকেও বেশ বড়। এর বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর ঘনত্বের চারগুণ। এর আকার এবং নিম্নমাধ্যাকর্ষণ শক্তি অনেকটা চাঁদের ঘন বায়ুমণ্ডলের মতো।
ইতিমধ্যেই নাসার পাঠানো এমন আরেকটি ড্রোন মঙ্গল গ্রহের উপরিতলে কাজ শুরু করেছে। পারসিভারেন্স রোভারের সাহায্যে ইনজেনুইটি নামের রবোটিক হেলিকপ্টারটি মঙ্গলে পৌঁছেছিল। জিনি নামে আদর করে ডাকা এই রবোটিক হেলিকপ্টারটি মূলত পরীক্ষামূলক ফ্লাইটের একটি সিরিজের জন্য পাঠানো হয়েছিল। ২০২১ সালের এপ্রিলে মঙ্গলগ্রহের মাটিতে অবতরণের পর থেকে এটি মঙ্গলের বুকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু নমুনা সংগ্রহ করতে পেরেছে। নাসা তাই এই মিশন আরও বেশ দীর্ঘ সময় ধরে চালাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ড্রোনটির সার্বিক নিরাপত্তা এবং ফ্লাইটের কার্যকারিতা নিশ্চিত করার জন্য শুধু ক্যামেরা এবং কয়েকটি মৌলিক যন্ত্র দিয়ে মূলত এই ড্রোনটি সজ্জিত। ড্রাগনফ্লাই যখন টাইটানে পৌঁছাবে, তখন এটি একটি সম্পূর্ণ পরীক্ষাগারই সঙ্গে নিয়ে যাবে। টাইটানের ভূতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য, এর বায়ুমণ্ডলীয় গঠন, চাঁদটির বৈশিষ্ট্যগুলোর স্বরগ্রাম প্রভৃতি বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য মূলত ড্রাগনফ্লাইকে ডিজাইন করা হয়েছে।
টাইটানের পৃষ্ঠ থেকে যে নমুনা পাওয়া যাবে, ড্রাগনফ্লাই সেগুলো বিশ্লেষণ করবে। এই উপগ্রহের মাটিতে কী ধরনের উপাদান রয়েছে, এখানে আসলেই জীবন সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান রয়েছে কি না সেগুলো খননকাজে একটি বিষয় ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করা হতে পারে। এর নাম ড্রাগনফ্লাই ড্রিল ফর অ্যাকুইজিশন অব কমপ্লেক্স অর্গানিকস বা DrACO। এই নমুনাগুলোকে পরবর্তী সময়ে অভ্যন্তরীণভাবে সংরক্ষণ করা হবে। সংরক্ষণ শেষে প্রাপ্ত নমুনাগুলোকে বিশ্লেষণ করা হবে ল্যান্ডারের মূল অংশের ভেতরে থাকা ‘অ্যাটিকে’র মাধ্যমে। এর অপর নাম ড্রাগনফ্লাই মাস স্পেকট্রোমিটার।
সেখানে আদৌ কোনো প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি না, থাকলেও তারা ঠিক কোন রূপে সেখানকার পরিবেশে অবস্থান করছে, হয়তো শিগগিরই আমরা সেসব বিষয়ে নতুন নতুন তথ্য হাতে পাব।