সহিংসতা, বোমা হামলা, গোলাগুলি আর মৃত্যুর আবহেই শনিবার পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট চলছে। ভোট শুরু হয়েছে সকাল ৭টায়, চলবে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। ভোট নেওয়া হচ্ছে ব্যালট পেপারে। এদিন সকাল থেকে ভোট কেন্দ্রগুলোতে লম্বা লাইন দেখা যায়। আগামী ১১ জুলাই হবে ভোট গণনা।
পুরো রাজ্যে এক দফায় এই পঞ্চায়েতের ভোট নেওয়া হবে। রাজ্যের ২২ জেলার মধ্যে দার্জিলিং এবং কালিম্পং জেলায় দুই স্তরে ভোট (গ্রাম সভা, পঞ্চায়েত সমিতি) এবং বাকি জেলাগুলোতে ত্রিস্তরীয় (গ্রাম সভা, পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ) ভোট নেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু ভোট শুরুর আগে থেকেই একের পর এক সহিংসতার খবর আসলো রাজ্যজুড়ে। ভোট সহিংসতায় পুরো রাজ্যে এখনো পর্যন্ত ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। যদিও কোন কোন মহলের দাবি নিহতের সংখ্যা ২৫ ছাড়িয়েছে। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের সহিংসতাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে এবারের নির্বাচন। শেষবার ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট সহিংসতায় মৃত্যু হয়েছিল ২৩ জনের।
এদিন সকালে উত্তর ২৪ পরগনার বারাসাতের কদম্বগাছির পঞ্চায়েতের পীরগাছা এলাকায় আব্দুল্লা আলী নামে এক নির্দল সমর্থকের মৃত্যু হয়। ওই ব্যক্তি আবদুল্লা পীরগাছা এলাকায় ৪১ এবং ৪২ নম্বর বুথে নির্দল প্রার্থী তাসলিমা বিবির বুথে এজেন্ট ছিল বলে জানা গেছে।
শুক্রবার রাতে তার ওপর হামলা চালানোর অভিযোগ উঠে ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। রাতেই তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় বারাসাত জেলা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। শনিবার সকালে তার মৃত্যু হয়। এই খুনের প্রতিবাদে টায়ার জ্বালিয়ে টাকি রোড অবরোধ করা হয়।
অপরদিকে মুর্শিদাবাদ জেলার খরগ্রামের রতনপুর গ্রামে এদিন সকালে এক তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী খুন হয়। সদর উদ্দিন শেখ নামের ১ তৃণমূল কর্মীকে খুনের অভিযোগের তীর জাতীয় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে।
মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙা থানার অন্তর্গত কাপাসডাঙ্গা ষষ্ঠীতলা এলাকায় তৃণমূল কর্মীকে খুনের অভিযোগ উঠেছে দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে। নিহত তৃণমূল কর্মীর নাম বাবর আলি। জানা গেছে, ভোটের আগের দিন শুক্রবার রাতে গ্রামে একটি চায়ের দোকানে বসেছিলেন তিনি। তখনই দুস্কৃতরা এসে ফুলচাঁদ শেখ ও বাবর আলীকে মারধর করে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। গুরুতর আহত অবস্থায় দুজনকে বহরমপুরে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হলে দিবাগত রাতে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।
খুনের ঘটনা ঘটেছে কোচবিহার জেলাতেও। শুক্রবার রাতে তুফানগঞ্জ-২ ব্লকের অধীনস্ত রামপুর এলাকায় দুই তৃণমূল কর্মীকে হামলার অভিযোগ ওঠে দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় গণেশ সরকার নামে এক তৃণমূল কর্মী আহত হয়। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে রাতেই তার মৃত্যু হয়। আরেকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এই জেলাতেই রাতে এক বাম সমর্থককেও গুলি করার অভিযোগে উঠেছে, তার অবস্থাও আশঙ্কা জনক।
এছাড়াও নদীয়া, পূর্ব বর্ধমান, পূর্ব মেদিনীপুর, উত্তর ২৪ পরগনা সহ একাধিক জেলা থেকে কোথাও রাতের অন্ধকারে ব্যালট বাক্স চুরি ও ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ, কোথাও কেন্দ্রীয় বাহিনী না থাকার কারণে ভোট বয়কটের ডাক, ভোট দিতে নিরাপত্তার অভাব বোধ করায় স্থানীয় মানুষের ভোট বয়কটের ডাক। পশ্চিম মেদিনীপুরে কোলাঘাট থানার বড়গাছিয়া ননীবালা বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী না থাকায় তালা মেরে ভোট বন্ধ করাসহ একাধিক অভিযোগ সামনে এসেছে।
ভোটের দিন সকালেই মুর্শিদাবাদ জেলার সামসেরগঞ্জের শুলিতলা এলাকায় ১৬ নম্বর বুথে সানাউল শেখ নামে এক তৃণমূল কর্মীকে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর অভিযোগ উঠেছে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। বর্তমানে অনুপনগর ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে তার চিকিৎসা চলছে।
হুগলী জেলার আরামবাগের আরাণ্ডি ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের সাতমাসা ২৭৩ বুথের নির্দল প্রার্থী জাহানারা বেগমের এজেন্ট কায়মুদ্দিন মল্লিককে গুলি করার অভিযোগ শাসকদের বিরুদ্ধে। ঘটনায় এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে চরম অব্যবস্থার অভিযোগে শনিবার সকালে শ্যামনগর বাসুদেবপুর মোড়ে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের গাড়ী বহর আটকান সিপিআইএম বিজেপি প্রার্থী ও নেতাকর্মীরা। তারা কথা বলেন রাজ্যপালের সাথে। রাজ্যপালও খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন। এরপরে তার গাড়ি বহর নদীয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
যদিও রাজ্য জুড়ে একের পর এক ভোট সহিংসতার ঘটনায় ইতোমধ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। ভোট সম্পর্কিত বিষয়ে সাধারণ মানুষের বিভিন্ন অভিযোগ জানতে ও সেগুলোর বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে রাজভবনে (গভর্নর হাউজ) পিসরুম চালু করেন রাজ্যপাল। পাশাপাশি গত দুই সপ্তাহ ধরে সন্ত্রাস কবলিত এলাকা গুলি পরিদর্শন করছেন তিনি। কথা বলছেন, নিহত ও আহতদের পরিবারের সদস্যদের সাথে।
উল্লেখ্য, এই নির্বাচনে গোটা রাজ্যে ভোট নেওয়া হবে মোট ৭৩ হাজার ৮৮৭ আসনে। এরমধ্যে রয়েছে ৩৩১৭ টি গ্রাম সভার ৬৩ হাজার ২২৯ আসন; ৩৪১ টি পঞ্চায়েত সমিতির ৯৭৩০ আসন; এবং ২২ জেলা পরিষদের ৯২৮ আসন।
প্রায় ২ লাখের বেশি প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারিত হবে। সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণের জন্য ভোট কেন্দ্র থাকছে ৬১ হাজার ৬৩৬ টি এবং মোট ভোটারের সংখ্যা ৫ কোটি ৬৭ লাখ ২১ হাজার ২৩৪।
তবে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে প্রতিটি বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের মোতায়েনের কথা থাকলেও একাধিক বুথে তাদের দেখা যায়নি। তার পরিবর্তে নজরে পড়েছে রাজ্য পুলিশ এবং সিভিক পুলিশ সদস্যদের।
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পর গ্রামসভা নির্বাচনে এই প্রথম কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসকে। বিজেপি ছাড়াও লড়তে হচ্ছে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের জোট প্রার্থীদের বিরুদ্ধে। এরই পাশাপাশি বেশ কিছু আসনে কড়া চ্যালেঞ্জ দিতে পারে ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ)-এর প্রার্থীরা।আগামী বছর ২০২৪ সালে দেশটিতে লোকসভা নির্বাচন, তার আগে এই নির্বাচন প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।