চলতি মাসের (জুলাই) শুরুতে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢুকেছে ভারী অস্ত্রের একটি চালান। এই অস্ত্রের চালান ক্যাম্পে ঢোকাতে রোহিঙ্গা নারী-শিশুদের ব্যবহার করা হয়েছে। মিয়ানমারের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) শীর্ষ নেতা ওস্তাদ খালেদের নেতৃত্বে অস্ত্রের এই চালান খালাস করা হয়। সম্প্রতি ক্যাম্পের একটি গোয়েন্দা সংস্থা এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৪৫০ জন আরসা সদস্য সক্রিয় রয়েছে। এখন তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে ওস্তাদ খালেদ। ইতিমধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এ অবস্থায় ক্যাম্পজুড়ে নজরদারি বাড়িয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একে-৪৭ আগ্নেয়াস্ত্রের চালান ঢোকার তথ্য নিশ্চিত করেছেন ক্যাম্পে দায়িত্বরত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) এক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘গত ৭ জুলাই আধিপত্য বিস্তার নিয়ে উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৮ ইস্ট, ব্লক-বি-১৭-১৮ সংলগ্ন এলাকায় আরসার সঙ্গে আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে আরসার পাঁচ সদস্য নিহত হয়। এরপর ভারী অস্ত্র সংগ্রহে মরিয়া হয়ে ওঠে আরসা। সে সময় সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে আরসার শতাধিক সদস্য বাংলাদেশ ঢুকে উখিয়া ও টেকনাফের উনচিপ্রাং এবং চাকমারকুল ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। ৯ জুলাই রোহিঙ্গা নারী-শিশুদের ব্যবহার করে ১০টি একে-৪৭ আগ্নেয়াস্ত্র ক্যাম্পে ঢুকিয়েছে আরসা। ওই চালানে আরও ভারী অস্ত্র ছিল। এসব অস্ত্র খালাসে নেতৃত্ব দেয় আরসার সামরিক শাখার প্রধান ওস্তাদ খালেদ।
র্যাব বলছে, গত ২১ জুলাই টেকনাফের গহীন পাহাড়ের গোপন আস্তানা থেকে আরসার সামরিক শাখার কমান্ডার হাফেজ নুর মোহাম্মদসহ সংগঠনের ছয় শীর্ষ সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়। নুর মোহাম্মদ ওস্তাদ খালেদের অন্যতম সহযোগী। মিয়ানমার থেকে কীভাবে তারা বাংলাদেশে এসেছে, কোথা থেকে কীভাবে কার্যক্রম চালাতো, কে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতো, কে বোমা বানাতো এবং কীভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতো এবং কে কোন দায়িত্বে ছিল, সব তথ্য র্যাবকে জানিয়েছে এই ছয় জন। তারা স্বীকার করেছে, গহীন পাহাড়ে আস্তানা বানিয়ে হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজি ও গুমসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড করে আসছিল। সেদিন তাদের কাছ থেকে একটি ৭.৬৫ এমএম পিস্তল, একটি বিদেশি রিভলবার, একটি শটগান, চারটি দেশীয় তৈরি এলজি, তিনটি রামদা ও গুলিসহ ৭০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। ওই সময় তাদের কাছে ভারী আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া যায়নি। এই ছয় জনকে গ্রেফতারের পর কোণঠাসা হয়ে পড়েছে আরসা। কারণ নুর মোহাম্মদ আরসা সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিতো এবং সংগঠনের অর্থ সংগ্রহের প্রধান হাতিয়ার ছিল।
তাদের গ্রেফতারের পর প্রেস ব্রিফিংয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, ওই ছয় জন আরসার সক্রিয় সদস্য এবং শীর্ষ সন্ত্রাসী। তারা পাহাড়ে আস্তানা তৈরি করে হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজি ও গুমসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিল। নুর মোহাম্মদের নেতৃত্বে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৩০-৩৫ জন খুন হয়েছে। এ ছাড়া অপহরণ, ডাকাতি, মাদক কারবার, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতো। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য সীমান্তবর্তী অঞ্চল দিয়ে অস্ত্র চোরাচালান করতো তারা। স্থানীয় বাসিন্দা ও রোহিঙ্গাদের খুন, অপহরণ ও গুমের ভয় দেখিয়ে চাঁদা নিতো। চাঁদা না পেলে অপহরণ করে শারীরিক ও পাশবিক নির্যাতন করে মুক্তিপণ দাবি করতো। মুক্তিপণ না পেলে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলতো।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভারী অস্ত্রের চালান ঢোকার বিষয়ে জানতে চাইলে ১৪-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক (অ্যাডিশনাল ডিআইজি) সৈয়দ হারুন উর রশিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ক্যাম্পে অস্ত্র আছে, এটা সত্য। তবে একে-৪৭-এর মতো ভারী অস্ত্র আছে কিনা আমার জানা নেই। থাকলে তো অভিযানে উদ্ধার হতো। গত চার-পাঁচ মাসে ২০টির অধিক অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে ভারী অস্ত্র আমরা পাইনি। উদ্ধারকৃত অস্ত্রের মধ্যে ওয়ান শুটার গান, পিস্তল ও দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে।’
আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আরএসও এবং আরসার মধ্যে মূলত দ্বন্দ্ব-খুনোখুনি উল্লেখ করে সৈয়দ হারুন উর রশিদ বলেন, ‘১১ লাখের বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। ঠিকানা বদলে নানা কৌশলে বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করছে আরএসও-আরসার সদস্যরা। তারা সবাই সন্ত্রাসী। তাদের ধরতে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।’
রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আরসা এবং আরএসও সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পে ঢুকে অস্ত্রের মহড়া দেয়। প্রায় দিনই রোহিঙ্গাদের ঘরে ঢুকে নারী-পুরুষদের অত্যাচার-নির্যাতন করে লুটপাট চালায়। এমন পরিস্থিতিতে নির্ঘুম রাত কাটছে তাদের। তবে এপিবিএন ক্যাম্পে অভিযান চালালে বিভিন্ন আস্তানা ও পাহাড়-জঙ্গলে অবস্থান নেয় সন্ত্রাসীরা। অভিযান শেষ হলে রাতে কাঁটাতারের বেড়া কেটে ক্যাম্পে ঢুকে অপকর্ম শুরু করে। মাঝেমধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে আরসা এবং আরএসও। বিশেষ করে কুতুপালং, লম্বাশিয়া, ঘোনারপাড়া, কুতুপালং, জামতলী, মধুরছড়া, টেকনাফের শালবনিয়া ও লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসা-আরএসও সন্ত্রাসীদের অবস্থান। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সক্রিয় নেতাদের টার্গেট করে খুন করছে তারা। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয় সবসময়।
জেলা পুলিশ ও এপিবিএনের তথ্যমতে, কক্সবাজারের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২০১৭ সাল থেকে এখন (২৪ জুলাই) পর্যন্ত ১৮৮ জন নিহত হয়েছেন। তাদের অধিকাংশই খুন হয়েছেন আরসার হাতে। বর্তমানে এসব রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৪৫০ জন আরসা সদস্য সক্রিয়। তাদের ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে আর্মড পুলিশের।