মাছ উৎপাদনে সমৃদ্ধ জেলা হিসেবে পরিচিত নেত্রকোণা। এ জেলার নদ-নদী ও হাওরগুলোতে পাওয়া যায় প্রচুর সুস্বাদু দেশীয় মাছ। এসব মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়েও দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়। তবে এ বছর মাছের ভরা মৌসুমেও খুব একটা মাছের দেখা মিলছে না।
এতে স্থানীয় বাজারগুলোতে আগের তুলনায় কয়েক গুণ বেড়েছে মাছের দাম। চাহিদা বেড়েছে পুকুরে চাষ করা মাছের। এছাড়া মাছের দেখা না পাওয়ায় অনেক কষ্টে দিন কাটছে জেলার শত শত জেলে পরিবারের জীবন।
জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য মতে, জেলায় সোমেশ্বরী, কংস, মগড়া, ধনুসহ ছোট বড় মিলিয়ে ৪৭টি নদ-নদী এবং ডিঙাপোতা, বোয়ালী, সোনাডুবি, গাগলাজুর, জালিয়ার হাওরসহ অন্তত ১৩৪টি হাওর রয়েছে। এসব হাওরে বছরে শতকরা ৪৫ শতাংশ মাছ উৎপাদন হয় এবং বাকি ৫৫ শতাংশ মাছ উৎপাদন হয় পুকুরে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বর্ষাকাল মাছের মৌসুম। এ সময় নদ-নদী ও হাওরগুলোতে মাছের প্রজননের ফলে বংশবিস্তার ঘটায়। কিন্তু এমন সময় নিষিদ্ধ বিভিন্ন প্রকার জাল যেমন- কারেন্ট জাল, ভরজাল, ভেসাল জাল, চায়না দুয়ারি জাল ইত্যাদি দিয়ে পোনা মাছ নিধন শুরু করেন স্থানীয়রা। ফলে মাছ ধরার মৌসুমেও আশানুরূপ মাছ মিলছে না। দেখা দিয়েছে মাছের সংকট। বিশেষ করে ভাদ্র মাসের শেষে পানি কমতে শুরু করে এবং আশ্বিন মাসের প্রথম থেকেই মাছ প্রচুর পরিমাণে মাছ ধরা পড়ে। তবে এ বছর জেলার নদী ও হাওরে তেমন মাছ পাচ্ছেন না জেলেরা। এছাড়া বেশিরভাগ উন্মুক্ত জলাশয় প্রভাবশালীদের দখলে থাকায় সেখানে জেলে ও সাধারণ মানুষকে মাছ ধরতে না দেওয়ায় জেলেরা ভোগান্তিতে পড়েছেন।
জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কান্দিউড়া ইউনিয়নের কইজানি নদী তীরবর্তী তাম্বুলিপাড়া জেলে পাড়ার বাসিন্দা নয়ন বর্মণ বলেন, আগে এমন সময় যে মাছ নদীতে পাওয়া যেতো তার সিকি ভাগও এখন পাচ্ছি না। জাল ও নৌকা নিয়ে সারা রাত নদীতে মাছ ধরার চেষ্টা করি, কিন্তু মাছ নেই। সামান্য যা পাই তা দিয়ে জীবন চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়া স্থানীয় হাওর ও বিলগুলো অন্যদের দখলে। তাই সেখানে আমাদের মাছ ধরতে দেওয়া হয় না।
জেলা শহরের মাছ বাজারের ব্যবসায়ী শামীম আহমেদের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, এখন হাওর, নদী, বিলগুলোতে প্রচুর মাছ পাওয়ার কথা। কিন্তু মাছ তেমন একটা নেই। তাই বাজারে যা আছে অধিকাংশ পুকুরের মাছ। তাও আবার এসব মাছের দামও অনেক। হাওর-বিলের মাছ কম থাকার কারণেই পুকুরে মাছের দাম বেড়েছে।
মাছের ক্রেতা জেলা শহরের কুড়পাড় এলাকার বাসিন্দা রোকন তালুকদার বলেন, বাজারে দেশি মাছ যেন এখন সোনার হরিণ। পুকুরে চাষ করা মাছও কিনতে হচ্ছে চড়া দামে। দিন দিনই আমরা প্রাকৃতিক জলাশয়ের মাছের স্বাদ ভুলে যাচ্ছি। এক সময় আমার এলাকার নদী, নালা, খাল-বিল ও হাওরগুলোতে প্রচুর পরিমাণে শিং, কই, মাগুর, গুতুম, টেংরা, বোয়াল, পাবদা, আইড়, শোল, মহাশোল, বাতাই, রাণী মাছ, পুঁটি, টাকি, চান্দা, গজার মাছ পাওয়া যেতো। এসব মাছ ছিল খুব সুস্বাদু। বর্তমানে এসব মাছ নেই বললেই চলে।
জেলার কেন্দুয়া উপজেলার সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আজহারুল আলম বলেন, নানা কারণেই দেশি প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত চার মাস দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ না ধরে প্রজনন ক্ষেত্র সংরক্ষণের কথা থাকলেও কেউ তা মানছেন না। বিভিন্ন প্রকার জাল দিয়ে পোনা মাছ ধরার ফলে কমে যাচ্ছে মাছের প্রজন্ম। তাই পুকুরে চাষ করা মাছই এখন ভরসা। তবে উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমরা জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে নিষিদ্ধ জাল উদ্ধারসহ জড়িতদের জরিমানা করা হচ্ছে।
তবে জেলায় মাছের উৎপাদন চাহিদার তুলনায় বেশি বলে জানিয়েছে জেলা মৎস্য বিভাগ। তারা জানায়, পুকুরে মাছ উৎপাদন বেশি হলেও জেলার বাসিন্দাদের মাছের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে নেত্রকোণার মাছ সরবরাহ করা হচ্ছে।