রবিউল ইসলাম সাতক্ষীরা: জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে দেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে শিকার হয়ে বসতভিটা হারিয়ে উদ্বাস্ত হয়েছে সাতক্ষীরার উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগর ও আশাশুনির অনেক পরিবার। অনেকে কর্ম হারিয়ে ছেড়েছেন এলাকা, এমনকি দেশও। সেই সাথে ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে এলাকার প্রাণী বৈচিত্র্য ও খাদ্য নিরাপত্তা। ফলে বেড়েছে বাল্য বিবাহ, ঝরে পড়ছে শিশুরা।
আশাশুনি উপজেলার উপকূলীয় প্রতাপনগর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ জাকির হোসেন বলেন, প্রতিবার প্রাকৃতিক দূর্যোগে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দূর্বল বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে এই ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চিংড়ি ঘের, ফসলি জমি, বসতবাড়িসহ অন্যান্য সহায় সম্পদ। অনেক সময় এমন অবস্থা হয়েছে কেউ মারা গেলে মাটি দেয়ার মত জায়গা টুকুও পানির উপরে জেগে ছিল না। নদী ভাঙনে ভিটাবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে অনেক পরিবার। অনেকে এলাকা ছেড়ে ঢাকা, খুলনা ও সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে গিয়ে রিকসা-ভ্যান চালিয়ে বা দিন মজুরি তে জীবিকা নির্বাহ করছে। অনেকে বাপ দাদার ভিটা আকড়ে ধরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এলাকার মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বলে দাবি করেন সাবেক এই ইউপি চেয়ারম্যান।
বিছট গ্রামের আব্দুল হাকিম মোড়ল জানান, প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে নদী ভাঙনে এই গ্রামের গাজী, মোড়ল ও সরদার বংশের প্রায় শতাধিক পারিবার বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে গ্রামের দু’টি মসজিদ, একটি এবতেদায়ী মাদ্রাসা, কবরস্থান, শতাধিক বিঘার ধান চাষের জমিসহ অন্যান্য স্থপনা। বাড়িঘর হারিয়ে অনেকে গ্রাম ছেড়ে দূরে গিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধের উপর টংঘর বেধে এখন বসবাস করছে। কেউ বা স্থায়ীভাবে গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে অন্যত্রে। এখনো নদী ভাঙনের হুমকির মুখে রয়েছে পুরো বিছট গ্রাম।
শ্যামনগর উপকূলের বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের পশ্চিম দূর্গাবাটি গ্রামের বাসিন্দা গিরিন্দ্রাথ রপ্তান জানান, পশ্চিম দুর্গাবাড়ি গ্রামে আগে চারশ’ পরিবার বসাবস করতো। এর মধ্যে দুই শতাধিক পরিবারের ভিটেমাটি ইতিমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। কেউ কেউ পাড়ি জমিয়েছেন দেশের বিভিন্ন জেলায়, কেউবা প্রতিবেশী দেশ ভারতে।
তিনি বলেন, বর্তমানের এই খোলপেটুয়া নদীর প্রায় মাঝ বরাবর ছিল তাদের বসত ভিটা। নদীভাঙনে সবকিছু হারিয়ে এখন তিনি প্রায় নিঃস্ব। এরই মধ্যে তার দুই ভাই সুকুমার রপ্তান ও সুকুপদ রপ্তানের পরিবারও চলে গেছে ভারতে। তবে, জন্মভূমি ছাড়েননি গিরিন্দ্রাথ রপ্তান।
গিরিন্দ্রনাথ রপ্তান আরো বলেন, ২০০৯ সালে আইলায় দুর্গাবাটির বেড়িবাধ ভেঙে আমাদের সবকিছু নদীগর্ভে চলে যায়। শুধু আমাদেরই নয়, এখানে বসবাস করতো রপ্তান, সরকার ও মোড়ল গোষ্ঠীর লোকেরা। তিন গোষ্ঠীই বেশির ভাগ সহায় সম্পত্তি ঘরবাড়ি এখন নদীর মাঝখানে। আমরা কোনো মতে অন্যের জায়গায় একটি খুপড়ি ঘর বেধে বসাবস শুরু করি। পরে এক খন্ড জমি কিনে সেখানে ঘর বেধে বসবাস করছি।
জলবায়ুু পরিবর্তন সম্পর্কে না জানলেও গাবুরার আব্দুল মজিদ জানান, ২০০৯ সালের পর প্রতিবছরই এক বা একাধিক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বিধ্বস্ত হয়েছে উপকূলের প্রতিটি পরিবার। কেউ ঘর-বাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন, কেউবা হারিয়েছেন ফসলের জমি। অনেকে কর্ম হারিয়ে ছেড়েছেন এলাকা। সেই সাথে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে এলাকার প্রাণ বৈচিত্র্য, খাদ্য নিরাপত্তা। বাসা বেধেছে পুষ্টিহীনতা, বিস্তার লাভ করেছে রোগ বালাই। বেড়েছে বাল্য বিবাহ, ঝরে পড়ছে শিশুরা। এরা বাধ্য হচ্ছে শিশু শমে।
পশ্চিম দূর্গাবাটি এলাকার বাসিন্দা সুপদ মন্ডল (৬২) বলেন, বার বার প্রাকৃতিক দুযোর্গের কারণে উপকূলের প্রতিটি পরিবারই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্য শুধু পশ্চিম দূর্গাবাড়ি গ্রামেরই ৩০টি পরিবার বাড়ি-ঘর হারিয়েছে।
স্থানীয় লক্ষ্মী রানী রপ্তান বলেন, পশ্চিম দূর্গাবাড়ি গ্রামে এখন আর ধান হয় না। বার বার ঘূর্ণিঝড় আর নদী ভাঙনে পুরো এলাকা লবণাক্ত হয়ে গেছে। এজন্য এলাকায় আর কাজ নেই, অনেকের ঘরে খাবারও থাকে না। আমার চোখে দেখা নদীর মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে সরকার, রপ্তান ও মোড়ল বংশের প্রায় এক হাজার বিঘা জমি।
তবে শুধু পশ্চিম দূর্গাবাটি গ্রামই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে শ্যামনগর উপকূলের পদ্মপুকুর, গাবুরা, মুন্সিগঞ্জ, কৈখালী, আটুলিয়া ও কাশিমাড়ি গ্রামের হাজারো পরিবার ভিটেমাটি হারিয়ে একরকম নিঃস্ব হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জলবায়ু কর্মী এসএম শাহিন আলম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলের মানুষ উদ্বাস্ত হয়ে পড়ছে। সংকট দিন দিন আরো বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করে উপকূলের মানুষের জানমালের নিরাপত্তায় সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। জলবায়ু ট্রাষ্টের অর্থ জলাবয়ু ক্ষতিগ্রস্তদের কল্যাণে ব্যয় করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, উপকূলের মানুষের জলবায়ু সংকট, দুঃখ-দুর্দশা ও বঞ্চনার কথা, মানুষের টিকে থাকার সংগ্রামের কথা আন্তর্জাতিক মহলের কাছে তুলে ধরার জন্য কপ-২৮ দুবাই সম্মেলনে যোগদান করেছেন সাতক্ষীরার শ্যামনগরস্থ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লিডার্সের নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মন্ডল এবং প্রকল্প সমন্বয়কারী কৌশিক রায়। আশা করছি তাদের মাধ্যমে আমাদেও সংকটের কথা জানতে পারবেন সংশ্লিষ্টরা।