দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত রোগীর জন্য একটি সুষম খাবার তালিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগীর যেহেতু ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়। আবার খাবার থেকে উৎপন্ন শরীরের জন্য অপ্রয়োজনীয় রাসায়নিক উপাদান যথাযথভাবে শরীর থেকে বের হতে পারে না। সুতরাং খাবার হওয়া উচিত খুবই সুপরিকল্পিত। যথাযথ চিকিৎসার পাশাপাশি যদি যথাযথ প্রক্রিয়ায় খাবার গ্রহণ করা যায়, তাহলে কিডনি বিকল জনিত জটিলতা রোধ এবং বিকলতার অগ্রগতি কমিয়ে আনা যায়।
পরিমিত পানি পান
দৈনিক একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের ২-৩ লিটার পানি পান করা উচিত। তবে গর্ভবতী মায়েদের অতিরিক্ত ৫০০ মিলি লিটার এবং দুগ্ধবতী মায়েদের অতিরিক্ত ১ লিটার পানি পান করা উচিত। কারণ আমাদের শরীর থেকে ঘাম ও শ্বাস- প্রশ্বাসের সঙ্গে প্রায় ১ লিটার পানি বেরিয়ে যায়। আর শরীরের আবর্জনা বের করতে প্রায় ১ লিটার প্রস্রাব হতে হয়। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি বিকল রোগীরা ১ লিটার আর ডায়ালাইসিস রোগীরা ৭৫০ মিলি লিটার থেকে ১ লিটার পানি পান করতে পারেন কারণ তাদের ক্ষেত্রে প্রস্রাব কমে যায়।
তবে সুস্থ মানুষের হঠাৎ করে বমি কিংবা পাতলা পায়খানা হলে হিসাব অনুযায়ী অতিরিক্ত পানি পান করতে হয়। আবার অতিরিক্ত বমি কিংবা পাতলা পায়খানা হলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়– কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত পানি বেরিয়ে গেলে কিংবা রক্ত ক্ষরণ হলে আকস্মিক কিডনি বিকল হতে পারে। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা নিলে আকস্মিক কিডনি বিকল রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন। যথাযথ পরিমাণ পানি পান না করলে কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
পরিমিত লবণ খাওয়া
প্রতিদিন ৫ গ্রামের কম লবণ খাবেন (২.৪ গ্রাম সোডিয়াম) – দিনে সব মিলিয়ে ১ চা চামচ লবণ। কারণ অতিরিক্ত লবণ খাওয়ার কারণে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। যার কারণে হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ। কিডনি বিকল রোগীদের ১৫% এর কিডনি বিকলের কারণ হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ। সুতরাং সবার উচিত পরিমিত লবণ খাওয়া। কিডনি সম্পূর্ণ বিকল নয় কিন্তু শরীরে পানি জমছে- এমন রোগ সমূহে শরীরে সোডিয়ামের আপেক্ষিক ঘাটতি দেখা যায়। আবার কিডনি সম্পূর্ণ বিকল হলে শরীরে লবণের আধিক্য দেখা যায়। উচ্চ রক্তচাপ জনিত কিডনি রোগীদের দিনে ২ গ্রাম বা আধা চা চামচের কম লবণ খাওয়া উচিত।
পরিমিত পটাশিয়াম গ্রহণ
কিডনি রোগীদের সব ধরনের ফল বা শাকসবজি খাওয়া নিষেধ, এটি একটি অজ্ঞ ধারণা।কিডনি রোগীর রক্তে যদি পটাশিয়ামের মাত্রা বেশি থাকে বা কিডনির কার্যকারিতা যদি ৩০–এর কম হয়, তাহলে উচ্চ পটাশিয়ামযুক্ত খাবার কম খেতে হবে। ডাবের পানি, কলা, খেজুর, শুকনা ফল, আলু, টমেটো ইত্যাদিতে পটাশিয়ামের মাত্রা অধিক থাকে। আপেল, পেয়ারা, আঙুর, নাশপাতি, জাম, তরমুজ—এ ফলগুলোয় পটাশিয়াম তুলনামূলক কম থাকে। এ ফলগুলো পরিমাণমতো খাওয়া যাবে। শাকসবজি সেদ্ধ করে পানি ফেলে দিয়ে তারপর রান্না করতে হবে। রক্তে পটাশিয়ামের মাত্রা যদি ৬.৫ মিলিমোল/লিটারের বেশি হলে হ্রদ যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। আবার পটাশিয়াম স্বাভাবিক মাত্রার কম হলেও নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
প্রোটিন বা আমিষ জাতীয় খাবার
আমিষ বা প্রোটিন আমাদের রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিডনি রোগীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যথাযথ জ্ঞানের অভাবে আমিষ খাওয়া ছেড়েই দেয় যে কারণে পুষ্টিহীনতা দেখা দেয় আর এর কারণে ইনফেকশনের হার বেড়ে গিয়ে দ্রুত কিডনি বিকল হতে পারে কিংবা আকস্মিক কিডনি বিকল হতে পারে। সুতরাং কিডনি রোগীদের উচিত যথাযথ নিয়ম মেনে পরিমিত আমিষ গ্রহণ করা। আমরা আমিষ ২ ধরনের উৎস হতে পাই একটি হলো প্রাণিজ আরেকটি উদ্ভিদ। একজন সুস্থ মানুষের প্রতিদিন তার ওজন হিসাব করে প্রতি কিলোগ্রাম ওজনের জন্য ১ গ্রাম আমিষ খাওয়া উচিত। কিডনি বিকল রোগীদের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ .৫-.৮ গ্রাম/কেজি। তবে অবশ্যই সেটি .৫ গ্রাম/কেজি’র কম যেন না হয়। তবে হ্যাঁ যদি কিডনি রোগের ৩য়-৫ম ধাপে এবং যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে তারা যদি আমিষের সঙ্গে সঙ্গে কিটো অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট খান তাহলে .২-.৪ গ্রাম/কেজি হিসাবে আমিষ খেতে পারেন। আর যদি কিটো অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট না খান তাহলে উচ্চ রক্তচাপ জনিত কিডনি বিকল রোগীরা .৫-.৬ গ্রাম/কেজি ওজন হিসাবে আমিষ খেতে পারেন ।
তবে ডায়াবেটিস জনিত ৩য়-৫ম ধাপের কিডনি বিকল রোগীরা প্রতিদিন .৬-.৮ গ্রাম/কেজি হিসাবে আমিষ খেতে পারেন। তবে কয়েকটি কিডনি রোগে প্রস্রাবের সঙ্গে আমিষ শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। তাদের ক্ষেত্রে রক্তে ইউরিয়া ও ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা দেখে আমিষের মাত্রা সমন্বয় করতে হয়। যদি ইউরিয়া ও ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা স্বাভাবিক থাকে তাহলে আমিষ বাড়িয়ে খেতে হয় সে ক্ষেত্রে ওজনের কেজি প্রতি ১.৫ গ্রাম হিসেবে আমিষ খেতে হয়।
পরিমিত ভিটামিন সি খাওয়া
একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ৫০০ মিলিগ্রামের বেশি ভিটামিন সি প্রয়োজন নেই। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভিটামিন সি কিডনিতে পাথর করে। পাথরের যথাযথ চিকিৎসা না করালে হতে পারে কিডনি বিকল। তা ছাড়া এক সঙ্গে অনেক কামরাঙ্গা খেলে হতে পারে আকস্মিক কিডনি বিকল। কিডনি রোগী তিনি ডায়ালাইসিস রোগী হোক আর দীর্ঘস্থায়ী কিডনি বিকল রোগী হন তিনি দৈনিক ৬০-১০০ মিলিগ্রামের বেশি ভিটামিন সি খাওয়া থেকে বিরত থাকবেন।