পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে রায়সাহেব বাজার মোড়ের দূরত্ব প্রায় ১ কিলোমিটার। দূরত্ব কম হলেও ওই সড়কের গাড়ি যেন চলেই না। বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে রায়সাহেব বাজার মোড় পর্যন্ত আসতে ঘণ্টার বেশি সময় পার করতে হয়। বেলা ১১টার কাছাকাছি সময়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বাসে উঠে দুপুর ১টা ১০ মিনিটে নেমেছেন গুলিস্তানে। এর মধ্যে বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে রায়েসাহেব বাজার মোড় পর্যন্ত আসতে ১ ঘণ্টা পার হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, গুলিস্তানে কাপড়ের দোকান থাকায় নিয়মিত এ পথে তার যাতায়াত করতে হয়। বাসা থেকে দোকানে আসা-যাওয়ায় অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। শুধু আজকে নয়, নিত্যদিনই যানজটের কবলে পড়তে হয় তাকে। এ সড়কে যানজটের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের লোকজন এ সড়ক দিয়ে যাতায়াত করেন। একই সঙ্গে সড়কটির দুই পাশে অবৈধভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের গাড়ি পার্কিং এবং ফুটপাত দখল করে গড়ে উঠেছে ভাসমান দোকান। এ সড়কটি পার হতে বাসে যেমন ভোগান্তি, হেঁটে গেলেও নিস্তার নেই বলে জানান এ ভুক্তভোগী।
শুধু এ ১ কিলোমিটার সড়কই নয়, সরেজমিন দয়াগঞ্জ থেকে গেন্ডারিয়া স্টেশন, যাত্রাবাড়ী থেকে দয়াগঞ্জ ব্রিজ, পোস্তগোলা ব্রিজ থেকে গেন্ডারিয়া থানা, নর্থব্রুক হল রোড, বুড়িগঙ্গা পাড় দিয়ে সদরঘাট-গাবতলী সড়কসহ পুরান ঢাকার বেশির ভাগ সড়কে এ চিত্র দেখা গেছে। একই সঙ্গে পুরান ঢাকার বেশির ভাগ সড়ক সরু। যেখানে পাশাপাশি দুটি প্রাইভেট কার যাওয়া সম্ভব নয়। ধোলাইখাল টং মার্কেট থেকে কবি নজরুল কলেজ, নর্থব্রুক হল সংলগ্ন প্যারীদাস রোডের শুরু থেকে শেষ প্রান্তে হেমেন্দ্র দাস লেন পর্যন্ত দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কের প্রশস্ততা কোথাও ১০ ফুটের বেশি নয়। দুটি রিকশা পাশাপাশি চলতে গেলে হরহামেশাই ধাক্কা লাগে। তখন পথচারীদের চলাচলের কোনো উপায় থাকে না। এ সড়কে ইঞ্জিনচালিত যানবাহন বা ব্যক্তিগত ছোট গাড়ি ঢুকলেই লেগে যায় যানজট। সেই জট কখনো কখনো রাস্তার পুরোটায়ই ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর।
এ চিত্র ধোলাইখাল টং মার্কেট, প্যারীদাস রোড বা ইসলামপুর রোডেই নয়, পুরান ঢাকার দু-একটি প্রধান সড়ক ছাড়া সব খানেই। এমন সড়কও আছে, যাতে একটি রিকশা ঢোকার কোনো ফুরসত নেই। একসঙ্গে দুজন হাঁটতে গেলে ধাক্কা লাগার আশঙ্কা থাকে। আবার এসব রাস্তার পাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, বাসাবাড়ি, আড়ত, মার্কেট এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ধোলাইখাল টং মার্কেটের দোকানের অনেক মালপত্র রাখা হয়েছে রাস্তায়। এতে রাস্তার প্রশস্ততা কমে অর্ধেক হয়েছে। এরই মধ্য দিয়ে দিন যাপন করছে পুরান ঢাকার লাখো নগরবাসী। অন্যদিকে লক্ষ্মীবাজারের ফুটপাত পরিণত হয়েছে ভ্রাম্যমাণ মার্কেটে। একই সঙ্গে বই কিনতে বাংলাবাজার, থান কাপড়ের জন্য ইসলামপুর, বাদামতলীর ফল আড়ত ও শ্যামবাজারের সবজি আড়তে প্রতিদিন ঢল নামে লাখো ক্রেতা-বিক্রেতার। আর এ সময় ফুটপাত হকারদের দখলে থাকায় পথচারীদের মূল সড়ক দিয়েই হেঁটে যেতে হয়। এ সময় ওই এলাকা চলাচলের জন্য অকেজো হয়ে পড়ে।
এখানেই ভোগান্তির শেষ নেই। যত্রতত্র ময়লা আবর্জনায় অতিষ্ঠ পুরান ঢাকার মানুষ। সিটি করপোরেশন উন্মুক্ত স্থানে ময়লা আবর্জনা না রাখার ঘোষণা দিলেও পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এমনকি দয়াগঞ্জ পুলিশ বক্স সংলগ্ন সড়কের ওপরে রাখা সিটি করপোরেশনের ময়লার কনটেইনার। এসব কনটেইনারের বাইরে সড়কেই ময়লা আবর্জনার স্তূপ দেখা গেছে।
এ ছাড়া দিনে কনটেইনারে ময়লা না রাখার ডিএসসিসি মেয়রের নির্দেশনা থাকলেও কেউ মানে না। এলাকার বিভিন্ন স্থান থেকে ভ্যানভর্তি করে ময়লা আনতেও দেখা গেছে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের। শ্যামবাজারের পাশে রাস্তার ওপর ময়লা আবর্জনার স্তূপ দেখা গেছে। ওখানে সবই বাজারের বর্জ্য।
ঝুঁকিপূর্ণ ভবন : পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, টিপু সুলতান রোড, নারিন্দা, নবাবগঞ্জ রোড, লালবাগ, খাজে দেওয়ান, চকবাজার, মিটফোর্ড, ইসলামপুর, জিন্দাবাহার, কসাইটুলী, নাজিরাবাজার, কাপ্তানবাজার, সাতরওজা, সূত্রাপুর, হাজারীবাগ, চকবাজার, বংশাল, কোতোয়ালি, শ্যামপুর, কামালবাগ ও কামরাঙ্গীরচরে কয়েক হাজার জরাজীর্ণ ঝুঁঁকিপূর্ণ পরিত্যক্ত ভবন রয়েছে। এসব এলাকায় কয়েক শ বছর পুরনো জরাজীর্ণ ভবনে বংশপরম্পরায় মানুষ বসবাস করে আসছেন। ভবনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো -স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের এডওয়ার্ড বিল্ডিং। এ ছাড়া এই হাসপাতাল কম্পাউন্ডে আরও কয়েকটি অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে কর্মচারীরা বসবাস করছেন। একই সঙ্গে পুরান ঢাকার ভবনগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি লাগোয়া। বেশির ভাগ ভবনই রাজউকের নিয়ম ভঙ্গ করে নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে এসব ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে।
পুরান ঢাকার যানজট প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর অঞ্চল ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, পুরান ঢাকার যানজট ঐতিহ্যগত সমস্যা। এই যানজটের অন্যতম কারণ জনঘনত্ব বেশি। একই সঙ্গে অধিকাংশই সরু রাস্তা এবং ফুটপাতগুলো থাকে অবৈধ দখলে। এ ছাড়া সরু রাস্তাগুলোতে সব ধরনের পরিবহন চলাচল করে। পরিবহন ব্যবস্থাপনায় কোনো শৃঙ্খলা না থাকায় যানজট তৈরি হচ্ছে।
সমস্যা সমাধানে এই নগর বিশেষজ্ঞ বলেন, পুরান ঢাকায় যে সড়কগুলো রয়েছে, সেগুলো পরিকল্পনার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। প্রথমত, পরিবহন যাতায়াতে একমুখী করা। একই সঙ্গে কোন সড়কে শুধু প্রাইভেট কার, কোনটিতে পরিবহনযোগ্য গাড়ি চলাচল এবং কোন সড়কে শুধু অযান্ত্রিক যান চলাচল করবে সে বিষয়গুলো সুনির্দিষ্ট করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যেগুলো সরু রাস্তা, সেগুলোকে হাঁটাবান্ধব সড়ক তৈরি করা। আর পুরান ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে ড্যাপে বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া রয়েছে। ড্যাপ বাস্তবায়ন করলে সচল হবে পুরান ঢাকা।