• শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫২ পূর্বাহ্ন

গাজায় চলমান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভুমিকায় ক্ষুব্ধ মার্কিন কর্মকর্তার পদত্যাগ

নিউজ ডেস্ক
আপডেটঃ : বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪
সংগৃহীত ছবি

ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান যুদ্ধে ইসরাইলকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের সমর্থনের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা। গত বুধবার অ্যানেল শেলাইন নামের এই কর্মকর্তা পদত্যাগের ঘোষণা দেন। একটি খোলাচিঠিতে পদত্যাগের কারণও তুলে ধরেছেন ৩৮ বছর বয়সী ওই নারী কর্মকর্তা।

অ্যানেল মার্কিন সরকারের পক্ষে মানবাধিকার বিষয়ে প্রচারের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য সংক্রান্ত দায়িত্বও পালন করতেন। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ইসরাইল নীতির বিরোধিতায় নিজের পদ ছেড়ে দেওয়া মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সর্বশেষ কর্মী তিনি। শেলিন বুধবার ওয়াশিংটন পোস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তার পদত্যাগের ঘোষণা দেন। মূলত তিনি এমন এক সময়ে বাইডেন প্রশাসন থেকে সরে দঁড়ালেন যখন গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় চলমান প্রায় ছয় মাসের ইসরাইলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩২ হাজার ৫০০ জনেরও বেশি এবং অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডে দুর্ভিক্ষ আসন্ন বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)।

শেলিন মার্কিন এই সংবাদপত্রকে বলেন, ‘আমি সত্যিই আমার কাজ আর করতে পারিনি। মানবাধিকারের পক্ষে কাজ করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে।’ শেলিনের পদত্যাগের আগে গত বছরের অক্টোবরে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের আরেক কর্মকর্তা জশ পল পদত্যাগ করেন। বাইডেনের গাজা নীতির প্রতিবাদে পদত্যাগ করা ওই কর্মকর্তা ছিলেন স্টেট ডিপার্টমেন্টের রাজনৈতিক-সামরিক বিষয়ক ব্যুরোর একজন পরিচালক।

এছাড়া একই কারণে গত জানুয়ারিতে পদত্যাগ করেন মার্কিন শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা তারিক হাবাশ। জ্যেষ্ঠ এই মার্কিন কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা বিভাগের পরিকল্পনা, মূল্যায়ন ও নীতি উন্নয়নের অফিসের বিশেষ সহকারী পদে ছিলেন। আল জাজিরার সাথে কথা বলার সময় হাবাশ বলেছেন, অ্যানেল শেলিনের চলে যাওয়ার এই সিদ্ধান্ত সেটিই স্পষ্ট করছে যে, গাজা যুদ্ধের মধ্যে দেশে এবং বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কীভাবে হ্রাস পেয়েছে।

 

তিনি বলেন, ‘এটা আশ্চর্যজনক নয়, এমন কিছু লোক আছেন যারা স্টেট ডিপার্টমেন্টে মানবাধিকার সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার চেষ্টা করলেও তারা মনে করছেন, তারা তাদের কাজ করতে অক্ষম। (শেলিন) হয়তো বুঝতে পেরেছেন, একমাত্র উপায় যে তিনি প্রভাব ফেলতে পারেন তা হলো তার চলে যাওয়া, কারণ প্রায় ছয় মাসে আমরা (মার্কিন) নীতিতে কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখিনি এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের প্রভাব দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।’

 

আল জাজিরা বলছে, ব্যুরো অব নিয়ার ইস্টার্ন অ্যাফেয়ার্সের অংশ হিসাবে ব্যুরো অব ডেমোক্র্যাসি, লেবার এবং হিউম্যান রাইটস (ডিআরএল)-এর একটি ফেলোশিপের মাধ্যমে স্টেট ডিপার্টমেন্টে যোগদান করেছিলেন অ্যানেল শেলিন। তাকে মানবাধিকারের প্রচার এবং এই ইস্যুতে বার্ষিক প্রতিবেদন সংকলনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তার পিএইচডি ডিগ্রি রয়েছে এবং এর আগে তিনি কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপন্সিবল স্টেটক্রাফ্টের গবেষক ছিলেন।

 

স্টেট ডিপার্টমেন্টে তার দায়িত্বের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলজুড়ে কর্মী এবং সুশীল সমাজের গ্রুপগুলোর সাথে সমন্বয় করাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি বলেন, যুদ্ধের অগ্রগতির সাথে সাথে এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে মার্কিন বিশ্বাসযোগ্যতা কীভাবে হ্রাস পেয়েছে তা তিনি নিজেই দেখেছেন।

শেলাইন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দুই বছরের চুক্তিতে নিয়োগ পান। তিনি ব্যুরো অব ডেমোক্রেসি, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড লেবারের পররাষ্ট্রবিষয়ক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। চাকরির মেয়াদের মাঝামাঝিতে এসে পদত্যাগ করলেন তিনি।

 

খোলাচিঠিতে কী আছে

শেলাইনের খোলাচিঠিটি সিএনএনের মতামত বিভাগে প্রকাশিত হয়েছে। ওই চিঠির কিছু অংশের ভাষান্তর নিচে তুলে দেয়া হলো:

 

গত ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের পর থেকে গাজায় যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বোমা ব্যবহার করে আসছে ইসরাইল। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ যুদ্ধে ৩২ হাজারে বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, তাঁদের ১৩ হাজারই শিশু। এ ছাড়া বহু মানুষের মরদেহ ইসরাইলি হামলায় বিধ্বস্ত বাড়িঘর ও স্থাপনার নিচে পড়ে আছে।

 

খাদ্য অধিকার–সম্পর্কিত জাতিসংঘের বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ারের মতে, গাজার বেঁচে থাকা ২০ লাখ মানুষকে অনাহারে রাখার জন্য ইসরাইল নিশ্চিতভাবেই অভিযুক্ত। দাতব্য সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের একটি দল সতর্ক করে বলেছে, পর্যাপ্ত ত্রাণসহায়তা না পেলে আরও হাজারো মানুষের নাম শিগগিরই মৃত মানুষের তালিকায় যোগ হবে।

এরপরও ইসরাইল এখনো রাফায় অভিযানের পরিকল্পনা করে যাচ্ছে, যেখানে গাজার অধিকাংশ মানুষ পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। জাতিসংঘের কর্মকর্তারা বলে আসছেন, সেখানে যে হত্যাযজ্ঞের আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেটা হবে ‘কল্পনাতীত’।

 

পশ্চিম তীরে সশস্ত্র বসতি স্থাপনকারী ও ইসরাইলি সেনারা মার্কিন নাগরিকসহ ফিলিস্তিনিদের হত্যা করে আসছেন। গণহত্যাবিষয়ক বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য অনুযায়ী, এসব কর্মকাণ্ড গণহত্যার অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। আর মার্কিন সরকারে কূটনৈতিক ও সামরিক সমর্থন নিয়েই এসব কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে।

 

মধ্যপ্রাচ্যে মানবাধিকারের প্রসারে গত বছর এই দপ্তরে আমি কাজ করেছি। দপ্তরের এই অভিপ্রায় এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজের প্রতি আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে। কিন্তু এমন একটি সরকার, যারা সরাসরি এমন বিষয়কে সহায়তা করছে, যা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত বলেছেন, গাজায় গণহত্যা ঘটে থাকতে পারে; তাদের প্রতিনিধি হয়ে এ ধরনের (মানবাধিকার নিয়ে) কাজ করে যাওয়াটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ ধরনের নৃশংসতাকে সহায়তা করে—এমন প্রশাসনের অধীন কাজ করতে অসমর্থ হয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আমার পদ থেকে আমি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

 

শুরুতে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে পদত্যাগের পরিকল্পনা আমার ছিল না। কারণ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আমার চাকরির মেয়াদ স্বল্পমেয়াদি। আমাকে দুই বছরের চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে আমার পদত্যাগে তেমন কিছু যায়–আসে বলে আমার মনে হয়নি। কিন্তু যখন আমি আমার পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করি, বারবার যে প্রতিক্রিয়া আমি শুনেছি, তা হলো, ‘অনুগ্রহ করে আমাদের হয়ে বলুন’।

 

কেন্দ্রীয় সরকারে আমার মতো যাঁরা কর্মী আছেন, কয়েক মাস ধরে তাঁরা নীতি পরিবর্তনে চাপ তৈরির চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। উভয়ভাবেই—অভ্যন্তরীণভাবে আর যখন তা ব্যর্থ হয়েছে, তখন প্রকাশ্যেই।

 

আমার সহকর্মীরা এবং আমি হতবিহ্বল হয়ে দেখলাম, এই প্রশাসন ইসরাইলকে নির্ভুলভাবে আঘাত হানতে সক্ষম হাজারো যুদ্ধাস্ত্র, বোমা, ছোট অস্ত্র এবং অন্যান্য প্রাণঘাতী অস্ত্র সহায়তা দিয়েছে। আরও হাজারো অনুমোদন করেছে, এমনকি কংগ্রেসকে পাস কাটিয়ে।

 

যুক্তরাষ্ট্রের আইনের প্রতি প্রশাসনের স্পষ্ট অবহেলায় আমরা হতবাক হয়েছি। এসব আইন মানবাধিকারের মারাত্মক লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত বা মানবিক ত্রাণ সরবরাহে বাধা দেয়—এমন বিদেশি সামরিক বাহিনীকে সহায়তা প্রদানে যুক্তরাষ্ট্রকে নিষেধ করে।

 

আমি যা করছিলাম, তা আর চালিয়ে যেতে পারছি না। আমি আশা করি, আমার পদত্যাগ ইসরাইলের যুদ্ধের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারে প্রশাসনকে চাপ দেওয়ার যে অনেক প্রচেষ্টা, তাতে অবদান রাখতে পারে। আর এটা হলো জীবনের ঝুঁকিতে থাকা ২০ লাখ ফিলিস্তিনি এবং বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থানের স্বার্থেই। সূত্র: আল-জাজিরা, সিএনএন।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ