দক্ষিণ লেবাননে ইসরাইলি ড্রোন হামলায় নিজেদের এক কমান্ডারসহ বেশ কয়েকজন নিহতের প্রতিশোধ নিতে গত বৃহস্পতিবার উত্তর ইসরাইলে একাধিক সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে কাতিউশা রকেট হামলা চালিয়েছে হিজবুল্লাহ।
এ ঘটনার মধ্য দিয়ে লেবানন-ইসরাইল সীমান্তে উত্তেজনা নতুন করে ছড়িয়ে পড়েছে। এর আগে বুধবার হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, ইসরাইল যদি তার গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ ঘোষণা করে, তবে দেশটির ‘কোনো স্থানই’ রেহাই পাবে না। এমনকি, সাইপ্রাস যদি ইসরাইলকে বিমান ঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি দেয়, তবে সাইপ্রাসকেও লক্ষ্যবস্তু করা হবে বলে হুমকি দেন তিনি।
উল্লেখ্য, গত ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি জঙ্গি গোষ্ঠী হামাসের হামলার পর থেকে ইসরাইল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই সীমান্তে গোলাগুলি বিনিময় হচ্ছে। হামাসের হামলার জের ধরেই গাজা উপত্যকায় যুদ্ধ শুরু হয়। গত বৃহস্পতিবার ইসরাইলি বাহিনী ড্রোনযোগে হামলা চালায় দেইর কিফা-স্রিফা সড়কে। এতে আব্বাস ইব্রাহিম হামাদেহ নামে এক গাড়িচালক নিহত হন। ইসরাইলি সেনাবাহিনী তাকে ‘জুয়াইয়া অঞ্চলের হিজবুল্লাহর একজন কমান্ডার’ বলে দাবি করেছে।
এর পাশাপাশি, হিজবুল্লাহর নেতা, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ জোমার ছেলে আম্মার জোমা হুমাইন আল-ফাউকায় যাওয়ার পথে ড্রোন হামলায় নিহত হন। টায়ার জেলার হানোইয়েহ শহরে ইসরাইলি ড্রোনের হামলায় একটি পিকআপ ভ্যানে থাকা দুই ব্যক্তি গুরুতর আহত হন। এর আগে বুধবার ইসরাইলি বাহিনী হিজবুল্লাহর চারটি স্থানে হামলা চালায়। এর কিছুক্ষণ আগেই লেবানন ও ইসরাইলের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের দূত আমোস হোচস্টাইন সেখান থেকে প্রস্থান করেন। উত্তেজনা প্রশমনে তিনি সোমবার তেল আবিব এবং মঙ্গলবার বৈরুত সফর করেন। বৃহস্পতিবার সকালে, ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ গ্যালান্ট জানান, লেবাননের সীমান্তবর্তী আপার গ্যালিলিতে অবস্থিত জিশ থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। নাসরাল্লাহর বুধবারের সে সকল হুঁশিয়ারি উভয় পক্ষেই শত্রুতার আশঙ্কাকে আরও বেশি করে তুলে ধরে।
ইসরাইলের ধর্মীয় পরিষেবা প্রদানকারী মন্ত্রী মাইকেল মালচিয়েলি চ্যানেল ১৪ নিউজকে জানিয়েছেন, তার মন্ত্রণালয়, যারা সমাধির জন্য দায়ী, ‘উত্তরাঞ্চলে যেকোনো অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিচ্ছে।’
অন্যদিকে, ইসরাইলি সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র আভিচাই আদ্রাই বলেন, ‘উত্তরে ইসরাইলের যুদ্ধ আত্মরক্ষামূলক। তবে দক্ষিণ লেবাননে ইসরাইলের অভিযান আরও ব্যাপক। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা লেবাননে সংঘাতের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করে তা অনুমোদনও দিয়েছেন। আমরা এখন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছি। আমাদের এখন মূল লক্ষ্য হলো হিজবুল্লাহকে সীমান্ত থেকে দূরে রাখা। হিজবুল্লাহ নেতৃত্ব ও তাদের স্বার্থবলিষ্ঠ স্থাপনার ওপর সুনির্দিষ্ট হামলার মাধ্যমেই আমরা আমাদের এই লক্ষ্য অর্জন করব।’ মারগালিয়ট বসতি পরিষদের প্রধান ইতান ডেভিডি বলেছেন, ‘এ অবস্থায় ইসরাইলে কোনো স্থানই নিরাপদ নয়।’
তিনি ইসরাইলি রেডিও নিউজকে বলেন, ‘যা আমাদের সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন করে তুলেছে তা হলো উত্তর সীমান্তে ইসরাইলি সরকারের নিরুত্তাপ ও দুর্বল ভূমিকা। নাসরাল্লাহ তার বক্তব্যে ইসরাইলের সকল অংশকেই লক্ষ্যবস্তু করার হুমকি দিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন যে হিজবুল্লাহর কাছে ‘এমন সব নতুন ধরনের অস্ত্র রয়েছে যা শীঘ্রই কার্যক্রমের মাধ্যমে সকলের সামনে উন্মোচিত হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যেকোনো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলায় সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত। আমাদের প্রতিরোধ এখন অভূতপূর্ব মানবশক্তিতে পরিপূর্ণ, কারণ আমাদের সদস্য সংখ্যা ইতোমধ্যে এক লাখ ছাড়িয়ে গেছে।’
‘ইসরাইলের এমন কোনো স্থান নেই যেখানে আমাদের ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানতে সক্ষম নয়। শত্রুপক্ষ ভালো করেই জানে যে আমরা যেকোনো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত। শত্রুরা এটাও জানে যে তাদের ভবিষ্যতে কী মুখোমুখি হতে হবে। যদি যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে আমাদের প্রতিরোধ যোদ্ধারা কোনও বাধা, নিয়ম বা সীমা ছাড়াই লড়াই করবে।’ তিনি সাইপ্রাস সরকারকে সতর্ক করে বলেন, ‘লেবাননকে লক্ষ্যবস্তু করার জন্য যদি শত্রুদের বিমান ঘাঁটি ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে তা মানে হবে সাইপ্রাস যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে।’
সাইপ্রাসের প্রতি এই হুমকি লেবাননে উদ্বেগ তৈরি করেছে এবং একতরফাভাবে যুদ্ধ ঘোষণা এবং বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোর প্রতি হুমকির কারণে হিজবুল্লাহর তীব্র সমালোচনা করা হচ্ছে।
লেবাননের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘লেবানন-সাইপ্রাস সম্পর্ক গড়ে উঠেছে কূটনৈতিক সহযোগিতার একটি সমৃদ্ধ ইতিহাসের ওপর। উভয় দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে নিয়মিত যোগাযোগ ও পরামর্শ চলমান রয়েছে।’ লেবাননের বিদেশ মন্ত্রী আবদাল্লাহ বু হাবিব সাইপ্রাস সরকারের তার সমকক্ষ কনস্টান্টিনোস কম্বোসের সঙ্গে ফোনালাপে বলেন, ‘আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাইপ্রাসের ভূমিকার ওপর লেবাননের সর্বদা নির্ভরতা রয়েছে।’
সাইপ্রাসের মন্ত্রী জোর দিয়ে বলেন যে, তার দেশ ‘সমস্যার অংশ হতে চায় না বরং সমাধানের অংশ হতে চায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই অঞ্চলে চলমান যুদ্ধের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত হতে চায় না সাইপ্রাস।’ এক্সে প্রোগ্রেসিভ সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রাক্তন নেতা ওয়ালিদ জুম্বল্ট লেখেন, ‘কয়েক দশক ধরে কঠিন সময়ে লেবানিজদের জন্য সাইপ্রাস একটি আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে আসছে।’
পার্লামেন্ট সদস্য ঘাসান হাসবানি নাসরাল্লাহর হুমকিকে ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’ বলে অভিহিত করে বলেন, ‘এই দলটি পূর্বে ভ্রাতৃপ্রতিম উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোকে হুমকি দিয়ে লেবাননকে একঘরে করে ফেলেছিল। আজ তারা সাইপ্রাসের মাধ্যম দিয়ে ইইউকে ও এই হুমকির আওতায় নিয়ে এসেছে।’ ন্যাশনাল লিবারেল পার্টি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে যে, ‘পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে লেবাননকে জড়িয়ে ফেললে ইসরাইল তাদের লক্ষ্য হাসিলের জন্য এবং দেশটিকে ধ্বংস করার জন্য একটি বাহানা পেয়ে যাবে।’
তারা আরও বলে, ‘লেবানন এবং লেবানিজদের অধিকাংশ যে পথে যেতে চান না সেই পথে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হবে দেশটিকে বন্দি করে রাখার একটি ষড়যন্ত্র। এর মাধ্যমে ইরান আরব অঞ্চলে তার ধর্মীয় নীতি বাস্তবায়ন করতে চাইছে।’
বৃহস্পতিবার জানা যায়, বৈরুতে অবস্থিত সাইপ্রিয়ট দূতাবাস ভিসা প্রার্থীদের জন্য দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। তবে দূতাবাস কর্মকর্তারা বলছেন, ‘বৃহস্পতিবার কেবলমাত্র একদিনের জন্য কনস্যুলেট কোনো ভিসা আবেদন বা কার্যকলাপ গ্রহণ করেনি।’
লেবাননের পরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে যে নাসরাল্লাহর মন্তব্যের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। সূত্র : রয়টার্স।