কুমিল্লার গোমতী নদীর নাব্যতা সংকট ও নদীর ওপর নির্মিত কম উচ্চতা ও ঝুঁকিপূর্ণ ২৩টি সেতু বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভারত-বাংলাদেশ নৌবাণিজ্যে। বছর চারেক আগে সেসব সেতুর সংস্কার, নদী খনন, নাব্যতা সংকট নিরসনসহ ভারতের সঙ্গে নৌবাণিজ্য জোরালো করতে গোমতীর নাব্য উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধারের একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনে দাখিল করা হয়েছিল। যার ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৫৩ কোটি টাকা। কিন্তু সেই প্রকল্পটি এখন পর্যন্ত আলোর মুখ না দেখায় সহসাই খুলছে না ভারতের সঙ্গে নৌবাণিজ্যের দুয়ার।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা বিবির বাজার স্থলবন্দর এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে বাংলাদেশ-ভারত নৌপথে পণ্য পরিবহন উদ্বোধন করা হয়। সেসময় প্রথমবারের মতো ১০ টন সিমেন্ট বোঝাই একটি নৌযান আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় কর্মকর্তাদের নিকট বুঝিয়ে দেয় বিআইডব্লিউটিএ। কিন্তু এদিন প্রথম চালানের নৌযানটি নাব্য সংকটের কারণে কুমিল্লা অংশের এ নদীর ওপর কম উচ্চতার ঝুঁকিপূর্ণ সেতুসহ অন্তত ১৪টি পয়েন্টে আটকে যাওয়ার প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে নির্ধারিত সময়ের প্রায় চার ঘণ্টা বিলম্বে ভারতের সোনামুড়া এলাকায় পৌঁছায়। তারপর থেকে গোমতী নদী হয়ে দুই দেশের নৌ-বাণিজ্যের সম্ভাবনার দুয়ার বন্ধ হয়ে যায়।
সেই সংকট নিরসনে সে বছর (২০২০ সালে) গোমতী নদী খননের মাধ্যমে নৌপথ উন্নয়ন করে সারা বছর পানিপ্রবাহ পুনরুদ্ধার, পণ্য ও যাত্রী পরিবহন সুবিধার জন্য বিআইডব্লিউটিএ ৩৫৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নাব্য উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধারের একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনে দাখিল করে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে গোমতী নৌপথের সমস্যাসংকুল এলাকায় ১৭১ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন নৌযান চলাচলের পথ উন্মুক্ত হবে এবং নাব্য উন্নয়ন করে ভারত-বাংলাদেশ নৌ-প্রটোকল চুক্তির আওতায় সহজ ও নিরাপদ আমদানি রপ্তানি তথা নৌ-বাণিজ্যের প্রসারতা বৃদ্ধি পাবে।
কিন্তু গত চার বছরেও সেই প্রকল্পটির অনুমোদন হয়নি। প্রকল্পটির অনুমোদন আদৌ হবে কি না তা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু ছালেহ মোহাম্মদ এহতেশামুল পারভেজ জানান, গোমতী নদী খনন প্রকল্প একাধিকবার পরিকল্পনা কমিশনে উপস্থাপন করা হলেও তার অনুমোদন মিলেনি। কখন এ প্রকল্পের অনুমোদন মিলবে, কিংবা আদৌ মিলবে কি না এ তথ্য জানা নেই আমাদের।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডম্বুর নামক স্থান থেকে উৎপন্ন হয়ে গোমতী নদী ১৫০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায় এসে পৌঁছেছে। কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার কটকবাজার, বিবিরবাজার, গোলাবাড়ি হয়ে জেলার বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, দেবিদ্বার, মুরাদনগর, তিতাস হয়ে দাউদকান্দির শাপটা নামক স্থানে মেঘনা নদীতে মিলিত হয়েছে। বাংলাদেশে এ নদীর দৈর্ঘ্য ১৩৫ কিলোমিটার।
জেলার ওই ৭টি উপজেলার কৃষিতে অনন্য ভূমিকা রাখা নদীটি বর্ষাকালে পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ থাকে। কিন্তু গ্রীষ্মকালে নদীর পানি শুকিয়ে প্রবাহের গতিধারা সরু হয়ে আসে। বর্ষাকালে এ নদীর কিছু এলাকায় নৌযান চলাচল করলেও শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত পানির অভাবে লঞ্চ, কার্গো, জাহাজ ইত্যাদি চলাচল করতে পারে না।
আবার কখনও নাব্যের অভাবে পানি বৃদ্ধি পেয়ে নদীসংশ্লিষ্ট এলাকায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয় এবং নদীর ওপর নির্মিত কম উচ্চতার সেতুগুলো হুমকির মুখে পড়ে। তাই এ নদীকে ‘কুমিল্লার দুঃখ’ বলা হয়ে থাকে।
কুমিল্লার বিবির বাজার স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জামাল আহম্মদ বলেন, গোমতী নদীর নাব্যতা সংকট নিরসন করে ভারতের সঙ্গে নৌবাণিজ্য চালু করলে দেশের অর্থনীতির গতি আরও বৃদ্ধি পাবে। সরকারের উচিত সেদিকে মনোযোগ বৃদ্ধি করা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ অলিউজ্জামান বলেন, গোমতী একটি ফ্লাশি (হঠাৎ পানি আসা ও চলে যাওয়া) নদী। গ্রীষ্মকালে এ নদীর নাব্য সংকট দেখা দেয়, আবার বর্ষায় পানি বৃদ্ধির কারণে নদীর ওপর কম উচ্চতার ও ঝুঁকিপূর্ণসহ ২৩টি সেতু পণ্যবাহী বড় জাহাজ চলাচলে সমস্যার সৃষ্টি করে। তাই নদী খননের মাধ্যমে নাব্য ফিরিয়ে আনার পর নৌরুটে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করতে হবে। এ নদী খননে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃক নেওয়া প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে গোমতী নদীতে পানিপ্রবাহ ও ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি এর নাব্যতাও বৃদ্ধি পাবে।