সরকারি ব্যয় নিয়ে চলমান জটিলতা কাটছে না যুক্তরাষ্ট্রের। আবারও শাটডাউনের মুখে পড়তে যাচ্ছিল দেশটি। তবে শেষ মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ অর্থবিল পাশ করে শাটডাউন এড়াতে পেরেছে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভে পাশ হওয়ার পর ডেমোক্র্যাট নিয়ন্ত্রত সেনেটেও বিলটি পাশ হয়েছে। এখন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের স্বাক্ষর করলেই এটি চূড়ান্ত হবে। যদিও বিলটিতে সংশোধনী আনতে প্রস্তাব দিয়েছিল মার্কিন সিনেটর র্যান্ড পল।
নতুন বিলটি পাশ না হলে শনিবার থেকে শাটডাউনের মুখে পড়তো মার্কিন সরকার। আর শাটডাউনে পড়লে কিছু জরুরি সেবা বাদে অন্যান্য সেবা খাতের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যেত। এতে অনেক সরকারিকর্মীর বেতনও পর্যন্ত বন্ধ যাওয়ার শঙ্কা ছিল। বড়দিন এবং ইংরেজি নববর্ষের ছুটির মুখে লাখ লাখ মার্কিনির দুর্ভোগের কারণ হয়ে উঠতে পারতো ফেডারেল গভর্নমেন্ট শাটডাউন।
এর আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আহ্বানের পরও (হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ) প্রতিনিধি পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রে শাটডাউন এড়াতে আনা সংশোধিত বিল পাশে ব্যর্থ হয় রিপাবলিকানরা। এমনকি দলটির কিছু প্রতিনিধিও বিলের বিপক্ষে ভোট দেন। বিলটি পাশে সংসদের নিম্নকক্ষ হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন প্রয়োজন ছিল।
বিল কীভাবে আইনে পরিণত হয়?
তৃতীয় দফা চেষ্টার পর হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ শাটডাউন রোধে অর্থ বিলটি পাশ করার পরও শাটডাউন রোধে মার্কিন সিনেটরদের অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল। একজন সেনেটর আপত্তি তুললেও শেষ পর্যন্ত অনুমোদন মিলেছে।
নিয়ম অনুযায়ী বিলকে আইনে পরিণত করতে হলে কংগ্রেসের হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ ও সিনেট উভয় জায়গা থেকেই অনুমোদন পেতে হয়। পরে সেটিতে প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষর করতে হয়।
মেয়াদ শেষে আগামী ২০ জানুয়ারি জো বাইডেন হোয়াইট হাউজ ত্যাগ করবেন। বিলটি পাশের পর রাতে হোয়াইট হাউজ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে তারা এই আইনটিকে সমর্থন করেন। এতে আরও বলা হয়, ‘যদিও ডেমোক্রেটদের সিনেটে খুব অল্প সংখ্যাগরিষ্ঠতা। তবুও এই বিলকে আটকে দেয়া বা ধীরগতির জন্য একজন সিনেটরের আপত্তিই যথেষ্ট। কিন্তু আমাদের হাতে আছে মাত্র দুই ঘণ্টা। এরপরই তহবিলের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। শাটডাউনের মুখে পড়বে মার্কিন সরকার।’
সিনেটে রিপাবলিকান সিনেটরের বিরোধিতা
মার্কিন ফেডারেল সরকারের শাটডাউন এড়াতে আনা এই বিলটির বিরোধিতা করেছিলেন রিপাবলিকান সিনেটর র্যান্ড পল। কিছু কারণকে সামনে এনে তিনি তার যুক্তিও তুলে ধরেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে পল স্পষ্টবাদী হিসেবে পরিচিত। তিনি এই বিলের বিরোধিতা প্রস্তাব নিয়ে যান মার্কিন সিনেটে। আপত্তি জানিয়ে বলেন, এই বিলে এমন কিছু ব্যয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যেটি পাশ হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরও বেশি ঋণের ফাঁদে পড়বে।
র্যান্ড পল যুক্তি দিয়ে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত যে এই বিল পাশ হলে এটি ইউক্রেনকে অর্থায়নে সহযোগিতা করবে কি না, কিংবা ভবিষ্যতে অন্য কোনো সমস্যা তৈরি হবে কি না সেটি বিবেচনা করেই নতুন তহবিল পাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।’
বিলটি নিয়ে যা যা হলো
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হলেও রিপাবলিকান পার্টি ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনো পদে বসেননি। আগামী ২০শে জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেবেন।
রাষ্ট্রীয় এই অর্থ বিলটির পক্ষে ভোট দিতে ট্রাম্প হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভের রিপাবলিকান আইনপ্রণেতাদের আহ্বানও জানিয়েছিলেন। তবে রিপাবলিকান কিছু কট্টরপন্থী সদস্যরা ট্রাম্পের আহ্বানে সাড়া দেয়নি। তারা এই বিলটির পক্ষে সমর্থন দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
বিলটির পক্ষে ১৭৪টি ভোট পড়ে। আর বিপক্ষে ২৩৫টি। বিপক্ষে ভোট দেন ৩৮ জন রিপাবলিকান আইনপ্রণেতাও।
যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় শুক্রবার মধ্যরাতে সরকারি তহবিলের মেয়াদ শেষ হবে। বিলটি পাশ হলে তা তহবিল জোগানোর মেয়াদ বাড়াবে। একই সঙ্গে তা ঋণের সীমা (ঋণ নেওয়ার সর্বোচ্চ পরিমাণ) স্থগিত করবে।
মার্কিন আইনপ্রণেতারা অর্থ বিলটি পাশে ব্যর্থ হলে মার্কিন সরকারের কার্যক্রম আংশিক ‘শাটডাউনে’ চলে যেতো।
ইলন মাস্কের প্রভাব
ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের পেছনে ইলন মাস্কের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা বলা হয়ে থাকে। ব্যয় সংক্রান্ত বিল ইস্যুতে আবারও আলোচনায় এসেছে মাস্কের প্রভাব। ট্রাম্প ও মাস্কের তাগিদের কারণেই ঐকমত্যে পৌঁছানো প্রথম বিলটি খারিজ করেছিলেন রিপাবলিকানরা।
কিন্তু সংশোধন করে আনা দ্বিতীয় বিলটির বেলায় রক্ষণশীলদের অনেকে মাস্কদের কথা শোনেননি। বিপক্ষে পড়া ওই ৩৮ রিপাবলিকানের ভোটই ফলাফল নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা রাখে। এই রাজনৈতিক নাটকীয়তা বিশৃঙ্খলা আর অনিশ্চয়তার স্বাদই দিলো আগামী দিনের শাসকদের।
অথচ সপ্তাহজুড়ে নাটকীয়তার কেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিটির কোনো সরকারি পদও নেই। তার আছে কোটি কোটি ডলার, একটি সোশ্যাল মিডিয়া মেগাফোন (চোঙা) এবং শ্রোতা হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট শুধু নয় কংগ্রেসের রক্ষণশীলরাও।
বুধবার সকালে এই টেক টাইকুন তার মালিকানাধীন সোশ্যাল মিডিয়া এক্স-এ প্রথম বিলটির বিপক্ষে প্রচারণায় নেমে পড়েন। বছর দুয়েক আগে ৪৪ বিলিয়ন ডলারে এক্স কেনেন মাস্ক।
হাউজ স্পিকার মাইক জনসন মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত সরকারি খরচ মেটাতে একটা সমঝোতায় পৌঁছেছিলেন। সেটির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন ইলন মাস্ক। একের পর এক পোস্টে যেসব বক্তব্য তিনি উপস্থাপন করেছেন তার কোনো কোনোটির যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। এতে শেষ পর্যন্ত সংকট আরো ঘনীভূত হলো।
ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচারণায় ব্যাপকভাবে সক্রিয় ছিলেন শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক। অনুদানও দিয়েছেন প্রায় ২০ কোটি ডলার। অবশ্য ট্রাম্প জেতার পরে মাস্কের সম্পদ বাড়ছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। বিজয়ী ভাষণে বিশেষভাবে মাস্কের কথা বলেন ‘প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট’। তার ভূঁয়সী প্রশংসাও করেন।
এর আগে ২০২২ সালে অবশ্য তিনি ট্রাম্পের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের পতনের ইঙ্গিত দিয়ে মন্তব্য করেছিলেন ‘ট্রাম্পের টুপি খুলে ঝুলিয়ে রাখা এবং সূর্যাস্তের দিকে যাত্রা করার সময় এসেছে।’ তবে সময় বদলেছে। প্রযুক্তি বিলিয়নিয়ার থেকে ট্রাম্পের অন্যতম দৃশ্যমান এবং সুপরিচিত সমর্থক হিসাবে প্রকাশ্যে এসেছেন ইলন মাস্ক। চলতি বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন করতে ‘আমেরিকা পিএসি’ নামে একটা রাজনৈতিক অ্যাকশন কমিটি গঠন করেছিলেন তিনি। এই নির্বাচনে সেখানে ২০ কোটি ডলার অনুদান দিয়েছেন মি. মাস্ক।
টেসলা ও স্পেসএক্সের প্রধান এবং সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্ম এক্স (সাবেক টুইটারের)-এর মালিক ইলন মাস্ক ভোটার রেজিস্ট্রেশন অভিযান (ভোটার নিবন্ধন অভিযান) চালু করেছিলেন।
প্রচারের সমাপনী পর্বে এই অভিযানের আওতায় সুইং-স্টেটের যেকোনও একজন ভোটারকে প্রতিদিন ১০ লক্ষ ডলার উপহার দেওয়া হতো। ১৩ জুলাই পেনসিলভানিয়ার বাটলারে হত্যা প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্পকে প্রথম সমর্থন দেয়ার পর থেকে, ইলন মাস্ক ট্রাম্পের প্রচারাভিযানের একটি অংশ হয়ে ওঠেন, যেখানে তিনি প্রায়শই সতর্কবার্তা দিয়ে আসছিলেন যে শুধুমাত্র ট্রাম্পই আমেরিকার গণতন্ত্রকে ‘বাঁচাতে’ পারেন। সূত্র: বিবিসি।