গত কয়েক বছর ধরেই সরকার বিশাল আকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিচ্ছে। কিন্তু অর্থবছরের শেষ দিকে এসে দেখা যাচ্ছে, লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেশ খানিকটা দূরেই থাকে আদায়। এর পর শেষ দিকে এসে তা সংশোধন করে কমিয়ে আনা হয়। গত চার বছর ধরে এটি একরকম নিয়মেই পরিণত হয়েছে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছর সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায় বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে ৩৫ শতাংশের বেশি। গত জানুয়ারি পর্যন্ত অর্থবছরের সাত মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায় বেড়েছে ১৫ শতাংশের কিছু কম। ঘাটতি প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে এ ঘাটতি আরো বেড়ে তা ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করছেন অর্থনীতিবিদরা। এনবিআর বহির্ভূত রাজস্ব হিসাবে ধরলে, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ঘাটতি ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়াতে পারে। ফলে অর্থবছরের শেষ দিকে এসে সরকার আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কাটছাঁট করতে যাচ্ছে বলেও শোনা যাচ্ছে। আলোচ্য সময়ে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে রাজস্ব আদায় বেড়েছিল ১৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
গত বাজেটে প্রায় ৩৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি ধরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে দুই লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। আর এনবিআর বহির্ভূত রাজস্ব মিলিয়ে মোট রাজস্বের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা বরাবরই আদায়যোগ্য ও বাস্তবসম্মত রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরার পরামর্শ দিয়ে আসছেন। অর্থমন্ত্রীর এমন প্রস্তাবের পর, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, চলতি বছর রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হতে পারে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ৩০ শতাংশের উপরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাকে অবাস্তব ও অর্জনযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন। ইত্তেফাককে তিনি বলেন, আদায় সর্বোচ্চ ২০ থেকে ২২ শতাংশ বাড়তে পারে। কিন্তু ৩৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কার্যত অসম্ভব। ফলে অতীতের ন্যায় চলতি অর্থবছরেও শেষদিকে এসে ফের সংশোধন করে কমিয়ে আনতে হবে। তিনি বলেন, বাজেটে বড় লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বাহবা আদায় করা গেলেও দীর্ঘমেয়াদে তা জনমনে গুরুত্ব হারাবে।
এনবিআরের হিসাবে, গত পাঁচ অর্থবছরে গড়ে রাজস্ব আদায় বেড়েছে ১৪ দশমিক ২৮ শতাংশ। গত তিন অর্থবছরে ১৫ দশমিক ২৯ শতাংশ, আর সর্বশেষ গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি প্রায় ১৯ শতাংশ। অথচ, গত তিন চার অর্থবছর জুড়েই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ শতাংশ বা এর কাছাকাছি ধরা হয়েছে।
গত বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেই বাজেটের প্রাক্কলনকে ‘উচ্চাভিলাষী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে নেওয়ার পক্ষে কিছু যুক্তিও তুলে ধরেছিলেন। গত আট বছরের রাজস্ব বোর্ডের নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা মোটামুটিভাবে এ ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছি যে, রাজস্ব প্রদান হয়রানির বিষয় নয়- রাজস্ব প্রদান জাতীয় দায়িত্ব। বাজেট বক্তৃতায় তিনি আরও বলেন, দেশের অর্থনীতির আকার দিন দিন বড় হচ্ছে। নতুন নতুন বিদেশি বিনিয়োগও দেশে আসছে। ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারিত হচ্ছে।
তবে বর্ধিত রাজস্ব আদায়ের জন্য এনবিআর নতুন নতুন খাত চিহ্নিত করার পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত সহজে আদায় করা যায়, এমন খাত বা ব্যক্তির উপরই বার বার করের ভার চাপিয়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ কর দাতাদের। কর দাতাদের কম কষ্ট দিয়ে বাড়তি রাজস্ব আদায়ের ইস্যুটি দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত হলেও বাস্তবতা ভিন্ন বলেই মনে করা হচ্ছে। যদিও এনবিআরের নতুন চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া কর দাতাদের কম কষ্ট দিয়ে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জনে আগ্রহী বলে জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে একাধিক বক্তব্যে তিনি বিষয়টি পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন। তবে যেকোন মূল্যে রাজস্ব আদায়ে কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কর্মকর্তাদের ওপর বাড়তি কর আদায়ের চাপ তৈরি হওয়ায় এর প্রভাব পড়ে মাঠ পর্যায়ে। এর ফলে ব্যবসায়ী ও করদাতাদের ওপর বাড়তি চাপ এবং হয়রানিও বাড়ে বলে মনে করেন তারা।