বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার হচ্ছে। ফলে এক দেশ থেকে অন্য দেশে মানুষের যাতায়াতও বাড়ছে। নিজের প্রয়োজনেই এক দেশ অন্য দেশের দক্ষ, আধা দক্ষ কিংবা বিশেষায়িত জ্ঞানসম্পন্ন কর্মী বা কর্মকর্তাদের আনছে। পারস্পরিক লাভালাভের কারণেই বিশ্বব্যাপী এটি ক্রমশ বাড়ছে। আবার পর্যটক হিসেবেও বিদেশ ভ্রমণ করছে বিশাল সংখ্যক মানুষ। তবে যে কোনো দেশই বিদেশি কর্মী কিংবা বিদেশির আসা-যাওয়ার মোটামুটি সঠিক তথ্য সংরক্ষণ করে। অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা, স্থানীয় নিরাপত্তা, আয়কর কিংবা যে কোনো প্রয়োজনে সঠিক পরিসংখ্যান প্রয়োজন হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি কর্মী কিংবা বিদেশি নাগরিকের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি সংস্থাগুলো যে তথ্য দিচ্ছে, তার সঙ্গে বাস্তবতার আকাশ-পাতাল তফাত্।
এক সময় বিনিয়োগ বোর্ড (বর্তমানে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা বিডা) একটি তথ্য দিয়েছিল, প্রায় ১২ হাজার বিদেশি কর্মী প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে ওয়ার্ক পারমিট নিয়েছে। অন্যদিকে সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও (এনবিআর) এ বিষয়ে হিসাব করে দেখেছে যে, মোটামুটি ১৪ হাজার বিদেশি কর্মীর আয়কর ফাইল রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে কি বিদেশি কর্মীর সংখ্যা আসলেই ১৪ হাজার? বিদেশি কর্মী ছাড়াও অনেকে স্বল্প সময়ের (সর্বোচ্চ ৩ মাস) ভিসায় বা পর্যটন ভিসায় আসেন। বিডা থেকে ওয়ার্ক পারমিট না নিলে তাদের বিদেশি কর্মী হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। অন্যদিকে এনজিও বিষয়ক ব্যুরো’র অধীনে কাজ করে- এমন কিছু বিদেশির পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে তাদের কাছে। এছাড়া ইমিগ্রেশন বিভাগ, পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার কাছেও বিদেশি নাগরিকদের আসা-যাওয়ার কিছু তথ্য থাকে।
সাধারণভাবে একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত যে, দেশে কয়েক লাখ বিদেশি নাগরিক রয়েছে। কিন্তু সেটি কয় লাখ? এর মধ্যে কতজন কাজ করে আয় করছেন, আর কতজন প্রকৃত আয় দেখাচ্ছেন? সরকারি পরিসংখ্যানে নির্ভর করতে গেলে ১২ থেকে ১৫ হাজারের মধ্যেই আটকে থাকতে হবে।
বিদেশি নাগরিকদের প্রকৃত সংখ্যা বের করার বিষয়ে মাঝে মাঝে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাতে কাঙ্ক্ষিত ফল মেলেনি। এজন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সমন্বয়হীনতাকেই দায়ী করা হচ্ছে। গত তিন বছর আগে থেকে এনবিআর এ বিষয়ে একটি উদ্যোগ নিলেও বিভিন্ন কারণে তাতে কাঙ্ক্ষিত গতি আসেনি। আবার এনবিআরের নজর মূলত যারা কাজ করে আয় করে, তাদের উপর। অর্থাত্ আয়কর যাদের কাছে পাওয়া যাবে। কিন্তু আমাদের দরকার কত সংখ্যক বিদেশি আছে বা তারা কী করছে। প্রতিদিনই বিদেশি নাগরিকদের আসা-যাওয়ার কারণে দেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদের প্রকৃত পরিসংখ্যান দেওয়া কঠিন। তবে যে তত্ত পাওয়া যাবে, তা যেন বাস্তবতার কাছাকাছি থাকে।
জানা গেছে, অনেক সময় নিয়োগকর্তার সঙ্গে যোগসাজশে ভিজিট ভিসায় এসে প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। ছয় মাস অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই ওই কর্মী ফের চলে গিয়ে কিছুদিন পর আবার আসে। বছরের পর বছর এভাবেই চলছে। অর্থাত্ এই ধরনের বিদেশি নাগরিক (সাধারণত আশ-পাশের দেশের) কর্মীর খাতায় নিবন্ধিত হয় না। ফলে তাদের আয়কর দিতে হয় না। কেউ কেউ একবার আসার পর বছরের পর বছর থাকছে। অবৈধভাবে কাজ করছে। দেশীয় কিছু প্রতিষ্ঠান তৃতীয় কোনো পক্ষের সহযোগিতায় এ কাজটি করছে। আবার যারা বৈধভাবে বা ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে কাজ করছে, তাদের যা বেতন, কাগজে-কলমে দেখায় তার চেয়ে অনেক কম। এ জন্য প্রতিষ্ঠান দুটি হিসাব বই সংরক্ষণ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। একটি আয়কর বিভাগকে দেখানোর জন্য। অন্যটি নিজস্ব হিসাবের জন্য। এসব টাকা হুন্ডি বা অন্য কোনো উপায়ে কর্মীর দেশে যায়।
সম্প্রতি জানা গেল, এই কর্মের সঙ্গে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী অনেক প্রতিষ্ঠানও জড়িত! এর ফলে মোটা অঙ্কের রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি নিয়মবহির্ভূতভাবে এভাবে বিদেশি কর্মী নিয়োগের ফলে দেশে নিরাপত্তা ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে। মাঝে মাঝে ঢাকায় অবস্থানরত আফ্রিকার কিছু দেশের নাগরিকরা পুলিশের হাতে আটক হওয়ার খবরও দেখা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিদেশি কর্মী নিয়োগ করে- এমন কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে সম্প্রতি চিঠি পাঠিয়েছে বিডা।
চিঠিতে বিদেশি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে কাজের অনুমতি নেওয়ার (ওয়ার্ক পারমিট) অনুরোধ জানানো হয় সংশ্লিষ্ট বিভাগকে। বিদ্যুত্ বিভাগ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয়সহ আরো কিছু বিভাগে বিদেশি কর্মী নিয়োগের প্রয়োজন হয়। বিদেশি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও ‘নিরাপত্তা ছাড়পত্র’ প্রয়োজন হয়। আর কাজের অনুমতির জন্য বিডা’র ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক। অনেক ক্ষেত্রেই বিদেশি কর্মীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে এ অনুমতি নেওয়া হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঠিকাদার কিংবা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে এসব কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও অনুমতি ছাড়াই ঠিকাদারের মধ্যে বিদেশি কর্মী নিয়োগ দেয়। অভিযোগ রয়েছে, এ প্রক্রিয়ায় হাজার হাজার কর্মী নিয়োগ হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বিদেশিদের যে কোনো পরিমাণ আয়ের উপর ৩০ শতাংশ হারে আয়কর প্রযোজ্য রয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী অনুমোদনহীন বিদেশি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তাদের জরিমানার বিধান আরোপ করেন। নতুন আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা ব্যবসায়ী যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বিদেশিদের নিয়োগ দিলে নিয়োগদাতা হিসেবে ওই ব্যক্তিকে তিন মাস থেকে সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আর্থিক দণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। একই সঙ্গে ওই নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের আয়কর সংক্রান্ত (কর অবকাশ, অব্যাহতি) সুবিধা থাকলে তাও বাতিল করা হবে।
জানা গেছে, সম্প্রতি এনবিআর বিদেশি কর্মী রয়েছে, এমন ১ হাজার প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করেছে। শিল্পাঞ্চল পুলিশের কাছেও একটি তালিকা রয়েছে। বাংলাদেশে মূলত ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ফিলিপাইন, চীন, কোরিয়া এবং ইউরোপ ও আমেরিকার কিছু দেশের নাগরিক রয়েছে। এর মধ্যে গার্মেন্টস ও টেক্সটাইলসহ বিভিন্ন কারখানা, বায়িং হাউজ, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, বেসরকারি সংস্থায় বিদেশি নাগরিকরা কর্মরত।
বলা হয়, বছরে এসব বিদেশি নাগরিকরা সবমিলিয়ে ৫শ’ থেকে ৬শ’ কোটি ডলার নিজ নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ তথ্যেরও নির্ভরযোগ্য কোনো ভিত্তি নেই। তবে এটি সত্য, দেশের নিয়োগকর্তার যোগসাজশে বিদেশি কর্মীরা বিশাল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। তার চাইতে বড় উদ্বেগের বিষয়, দেশের নিরাপত্তা ইস্যুতে।