• সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৪৮ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম:

অসংক্রামক ব্যাধি ঝুঁকিতে বেশি বয়সের গর্ভবতী মা

আপডেটঃ : সোমবার, ২ এপ্রিল, ২০১৮

একটি সরকারি কলেজে পড়ান নাদিয়া ইসলাম। জীবনের প্রতিটি পরীক্ষায় ভাল করেছেন। তারপর বিসিএস দিয়ে, দেশের বাইরে গিয়ে পিএইচডি করা, সব মিলিয়ে মা হওয়ার পরিকল্পনা করতে তার একটু দেরিই হয়ে যায়। পড়াশুনা শেষে বিয়ে হলেও বিসিএস পিএইচডি এমন পরীক্ষাগুলো তাকে সময় মত মা হওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে দূরে রেখেছে। স্বামীও তাকে ক্যারিয়ারের সাফল্যে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন। যেখানে যেখানে সম্ভব স্বামীর সহযোগিতার হাত নাদিয়াকে এগিয়ে দিয়েছে আরও কয়েক ধাপ। এইসব কিছু শেষে যখন নাদিয়া মা হওয়ার জন্য মন স্থির করেন তথন গর্ভধারণ করতে পারছিলেন না। একে এক কেটে যায় ৭টি বছর। এই বছরগুলোতে সে সব সময় বিষেশজ্ঞ চিকিত্সকের পরামর্শ নিয়েছেন। ৩৫ বছর বয়সের পর নাদিয়ার জীবনে আসে প্রথম সন্তান। তার গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস-এর প্রভাব ছিল বেশ বেশি। ফলে সময়ের আগেই তাকে অপরিনত শিশুর মা হতে হয় অপারেশনের মাধ্যমে। রাশিয়ায় মাস্টার্স করেন অবন্তি সমজদার। পড়াশুনা শেষে দেশে ফিরে একটি গণমাধ্যমে কাজ শুরু করেন। সেখানেই পরিচয় হয় আবিরের মাহমুদের সাথে। তাদের ভালবাসার সম্পর্ক ছিল পাঁচ বছর। এর মধ্যে আবির তার দুই বোনকে বিয়ে দিয়ে নিজের বিয়ের প্রস্তুতি নিয়েছেন। আবির অবশ্য অবন্তিকে অন্যত্র বিয়ে করতে বলেছিল কিন্তু অবন্তির তাতে মত ছিল না। ফলে তাদেরও বিয়ে হয় দেরিতে। এখন তার মা হতে খুব ভয় লাগে। কারণ সে নিজেই তার এক বোনকে বেশি বয়সে প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম দিতে দেখেছেন। আবার এখন চেষ্টা করলেই যে মা হতে পারবেন তার নিশ্চয়তাও নেই। তাই আর চেষ্টাও করছেন না। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান আসাদি। বিয়ের পরে তার মাস্টার্স পরীক্ষা দিতে হয়। ফলে তখন আর সন্তান নিতে পারেননি। পরে চাকরিতে ঢুকেও একবছর লাগে তার নিজেকে গুছিয়ে নিতে। যখন সন্তান নিতে চেষ্টা করেন তখন আর গর্ভধারণ হচ্ছিল না। মা না হওয়ার কষ্ট তাকে মানসিক ভাবে অনেক দুর্বল করে ফেলে। স্বামী ডাক্তার হওয়ায় সবসময় ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে পাশে ছিলেন। নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা আর ওষুধের ফলে এক সময় আল্লাহ যেন মুখ তুলে তাকান। পরপর দুই ছেলে আসে তাদের সংসারে। প্রথম সন্তান জন্মের সময় একটু বেশি কষ্ট পান আসাদি।
এই সময়ের নারী ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবনা আর অর্থনৈতিক চাপের মুখে পড়ে অনেকেই মা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে ফেলেন। ফলে ৩৫ বয়সোর্ধ্ব গর্ভবতী মায়ের সংখ্যা সমাজে দিন দিন বাড়ছে। বেশি বয়সের মায়েরা অসংক্রামক ব্যাধি জনিত ঝুিঁকর মধ্যে থাকে। সরকারের তথ্য-উপাত্ত মতে, রক্তক্ষরণে সবচেয়ে বেশি ৩১ শতাংশ মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। গর্ভধারণের পর থেকে যে কোনো সময় রক্তক্ষরণ হতে পারে। প্রসবকাল ও পরবর্তী কয়েকদিন এক্ষেত্রে উচ্চঝুঁকির সময়। এরপরই রয়েছে খিঁচুনিতে মায়ের মৃত্যু ২০ শতাংশ। প্রসব বাধাগ্রস্ত বা বিলম্বিত প্রসবজনিত জটিলতায় ৭ শতাংশ মায়ের মৃত্যু ঘটছে। গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে ঘটছে মোট মাতৃমৃত্যুর ১ শতাংশ। অন্যান্য প্রত্যক্ষ কারণে ৫ শতাংশ মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। পরোক্ষ কারণ কেড়ে নিচ্ছে ২০ শতাংশ মায়ের প্রাণ। মাতৃমৃত্যুর পরোক্ষ কারণের মধ্যে রয়েছে নানারকম সংক্রামক ও অসংক্রামক ব্যাধি, বেশি বয়সে সন্তান ধারণ এবং অতিরিক্ত সন্তান নেয়া। এছাড়া শ্রেণীবিন্যাসে পড়ে না এমন সব কারণেও ১৬ শতাংশ মায়ের মৃত্যু ঘটছে। সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্স স্টাডিজ শীর্ষক গবেষণা সংস্থা (সিএনআরএস) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, কানাডার ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয় ও চ্যানেল আই-এর প্রকৃতি ও জীবন যৌথভাবে অসংক্রামক ব্যাধিজনিত ঝুিঁক নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করছে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর বলছে, পুরো গর্ভকাল এবং প্রসব-পরবর্তী ৪২ দিন পর্যন্ত সময়ে মায়ের মৃত্যু ঘটলে সেটাকে মাতৃমৃত্যু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গত ২০ বছরে মাতৃমৃত্যু হ্রাসে রাষ্ট্রীয় অর্জন ভালো। তবুও এমডিজি লক্ষ্য অর্জনে চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। এই সকল ঝুিঁকর জন্য কি দেরি করে বিয়ে হলে মেয়েরা মা হতে পারবেন না।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ
ডা. ফেরদৌসী বেগম
অধ্যাপক স্ত্রী ও ধাত্রী বিদ্যা বিভাগ, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ ও বারডেম হাসপাতাল
বয়স্ক মায়েদের গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপে ভোগার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। গর্ভকালীন নিয়মিত ব্লাড প্রেসার চেক আপের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপজনিত জটিলতা এড়ানো যায়।
বেশি বয়সে মা হতে চাইলে কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন, যেমন: গর্ভধারণে দীর্ঘসূত্রতা, ডায়াবেটিসে, উচ্চ রক্তচাপ, সিজারের সম্ভাবনা বৃদ্ধি, নবজাতকের অস্বাভাবিক অবস্থান, ভ্রূণের জিনগত ত্রুটি, অধিক গর্ভপাতের সম্ভাবনা, কিডনি সমস্যা, মাল্টিপল প্রেগনেন্সি (একাধিক বাচ্চা গর্ভধারণ), সময়ের আগেই বাচ্চা হওয়া, একলামশিয়া, গর্ভস্থ বাচ্চার মৃত্যু, কম ওজনের বাচ্চা জন্মদান, নবজাতকের অসুস্থ ওজন বৃদ্ধি, এবরসন হওয়ার আশঙ্কা, জরায়ুর বিশেষ ধরনের টিউমার, থাইরয়েড জনিত সমস্যা ইত্যাদি জটিলতা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে। গর্ভকালীন সময়ে কোনো  কোনো মা ডায়াবেটিসে ভুগে থাকেন। অধিক বয়সে গর্ভধারণ করলে এর সম্ভাবনা আরো বেড়ে যায়। কনসিভ করার আগে থেকেই কিছু মা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত থাকতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কনসিভ করার আগ থেকেই তাকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, বয়স্ক মায়েদের গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপে ভোগার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। গর্ভকালীন নিয়মিত ব্লাড প্রেসার চেক আপের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপজনিত জটিলতা এড়ানো যায়। যারা আগে থেকেই উচ্চ রক্তচাপের জন্য ওষুধ খাচ্ছেন তাদের উচিত গর্ভধারণের আগেই ডাক্তারের পরামর্শে বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর ওষুধ পরিবর্তন করা। আমাদের দেশে মাতৃমৃত্যুর হার এখনও বেশি। মারা যাওয়ার ৫০ শতাংশ মা অসচেতনতার জন্য মারা যায়। এজন্য সরকার ও গণমাধ্যমে বেশি প্রচারণা জরুরি।
ডা. রেহানা আক্তার
ডেপুটি প্রজেক্ট ডিরেক্টর স্টাব্লিসম্যান্ট অব ন্যাশনাল সেন্টার ফর সারভিক্যাল ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিনিং এন্ড ট্রেনিং, স্ত্রী ও ধাত্রী বিদ্যা বিভাগ, বিএসএমএমইউ
৩০ বছরের পর কেউ যদি মা হবার জন্য ছয় মাস চেষ্টা করার পরও ব্যর্থ হন, তবে দেরি না করে অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শে ডিম্বাণু উৎপাদক ওষুধ খেতে হবে।
একজন মেয়ে জন্মের সময় কিছু সংখ্যক ডিম্বাণু নিয়ে জন্মায় যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিঃশেষ হতে থাকে। ৩০ বছরের পর থেকেই ডিম্বাণুর সংখ্যা এবং গুণগত মান কমতে থাকে। এতে করে এ সময়ে গর্ভধারণ করার চেষ্টার পরও দিনের পর দিন ব্যর্থ হতে পারে। তাই ৩০ বছরের পর কেউ যদি মা হবার জন্য ছয় মাস চেষ্টা করার পরও ব্যর্থ হন, তবে দেরি না করে অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শে ডিম্বাণু উত্পাদক ওষুধ খেতে হবে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে ভ্রূণের জিনগত ত্রুটি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। মায়ের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে ডাউন সিনড্রোম (ক্রোমোজোমাল ত্রুটিপূর্ণ বাচ্চা) নিয়ে বাচ্চা জন্মানোর হারও বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, ২৫ বছর বয়সী মায়েদের ডাউন সিনড্রোম বাচ্চা হওয়ার ঝুঁকি থাকে প্রতি ২৫০০ জনের মধ্যে একজনের, যা ৪০ বছর বয়সী মায়েদের ক্ষেত্রে গিয়ে দাঁড়ায় প্রতি ১০০ জনে একজন। তাই এই সময় গর্ভবতীদের বিশেষ আলট্রাসোনোগ্রামের মাধ্যমে শিশুকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। কনসিভের তিন থেকে চার মাসের মধ্যে ভ্রূণের জিনগত ত্রুটি শনাক্ত করা সম্ভব। এসময় মায়েদের স্বামীসহ পারিবারিক সহযোগিতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। প্রয়োজন স্বাভাবিক জীবন-যাপন ও বিনোদন।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ