ভোক্তাদের শংকাই কি সত্যি হচ্ছে ! রমজানের আগেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসেবেই গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজ, রসুন ও শুকনা মরিচের দাম বেড়েছে। অথচ রমজান উপলক্ষে এবার চাহিদার তুলনায় কয়েকগুণ বেশি নিত্যপণ্যের মজুত রয়েছে। পবিত্র রমজান শুরু হওয়ার মাত্র ১০দিন আগে যৌক্তিক কোন কারণ ছাড়াই পেঁয়াজের দাম বাড়ায় হতাশ ভোক্তারা।
এদিকে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি রোধে মাঠে নামছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। নিত্যপণ্যের অবৈধ মজুদ, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি মনিটর করবে তারা। এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ১৪টি টিম বাজারে নজরদারি করবে। রমজানে কারসাজি করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ালে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রমজানে মূলত ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, খেঁজুর ও পেঁয়াজের চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রতি বছর রমজানে ভোজ্যতেলের চাহিদা থাকে আড়াই লাখ টন, চিনি ৩ লাখ টন, ছোলা ৮০ হাজার টন, খেজুর ১৮ হাজার টন এবং পেঁয়াজ ৪ লাখ টন। কিন্তু বর্তমানে দেশে ভোজ্যতেলের মজুত রয়েছে ২২ দশমিক ৫৯ লাখ টন, চিনি ৪ দশমিক ৩৫ লাখ টন, ছোলা ৭ লাখ ৪৬ হাজার টন, খেজুর ৬৪ হাজার টন ও পেঁয়াজের মজুত রয়েছে ১৭ দশমিক ৯১ লাখ টন। গত মার্চ পর্যন্ত এলসি খোলা ও নিষ্পত্তির হিসাব ধরে মজুতের এ হিসেব দেয়া হয়েছে। এ হিসেবে দেশে চাহিদার তুলনায় কয়েকগুন বেশি নিত্যপণ্যের মজুত রয়েছে।
এছাড়া বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারেও এসব পণ্যের দাম নিন্মমুখী। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম কেজি প্রতি ৬২ থেকে ৬৪ টাকা, ছোলা ৪৬ থেকে ৪৮ টাকা, খেজুর প্রতি কেজি ৭০ টাকা, চিনি ৩৮ থেকে ৪১ দশমিক ৭৬ টাকা ও পেঁয়াজের দাম ১৮ টাকা ৬৫ পয়সা থেকে ২০ টাকার মধ্যে উঠানামা করছে। পেঁয়াজ আমদানির প্রধান উৎস ভারতের বাজারে কোনো অস্থিরতা নেই। দেশে উৎপাদনও হয়েছে পর্যাপ্ত। কিন্তু কোন কারণ ছাড়াই পেঁয়াজের দাম বাড়তে শুরু করেছে।
টিসিবির হিসেবে সোমবার রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৪৫ থেকে ৫০ টাকা ও আমদানিকৃত পেঁয়াজ ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হয়। কিন্তু এক সপ্তাহ আগে দেশি ও আমদানিকৃত পেঁয়াজের দাম ছিল যথাক্রমে ৩৮ থেকে ৪৫ টাকা ও ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। গত এক মাস ধরেই নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটির দাম বাড়তি। সরকারের এই সংস্থাটির হিসেবে গত এক মাসে দেশি পেঁয়াজের দাম ৩৫ দশমিক ৭১ শতাংশ ও আমদানিকৃত পেঁয়াজ ২৫ শতাংশ বেড়েছে।
সোমবার রাজধানীর কাওরানবাজারে বাজার করতে আসা চাকরিজীবী কবির হোসেন বলেন, ব্যবসায়ীরা রমজানে উপলক্ষে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর কৌশল বদলেছেন। আগে রমজানের সময় বাড়ানো হতো। আর এখন বাড়ানো হয় রমজানের আগে। পেঁয়াজ, রসুন, শুকনা মরিচের দাম বাড়া সে কথাই প্রমাণ করে। কারণ, এখনতো এসব পণ্যের দাম বাড়ার কোন কারণ নেই। এছাড়া ১৫দিন আগে বেগুনের কেজি ছিল ৪০ টাকা। আর এখন ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি হয়ে গেছে। এর কোন সদুত্তর নেই ব্যবসায়ীদের কাছে।
সম্প্রতি রমজানকে সামনে রেখে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (ডিসিসিআই) আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, পণ্য মূল্যবৃদ্ধির মূলে রয়েছে প্রথাগত বাজার সরবরাহ প্রক্রিয়া, অতিরিক্ত মজুতকরণের মাধ্যমে বাজারে পণ্যদ্রব্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, অপর্যাপ্ত ও সমন্বয়হীন বাজার মনিটরিং, পরিবহনখাতে চাঁদাবাজি, যানজট এবং অতিরিক্ত পরিবহন ব্যয়।
এদিকে রমজান উপলক্ষে বাজারে নিত্যপণ্যের সরবরাহ বাড়াতে ও স্বল্প আয়ের মানুষের সুবিধার্থে টিসিবি নায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি শুরু করেছে। গত রবিবার থেকে সারাদেশে পণ্য বিক্রি শুরু হয়েছে। রাজধানীতে ৩২টি, চট্টগ্রামে ১০টি, অন্য বিভাগীয় শহরগুলোতে পাঁচটি এবং জেলাগুলোতে দুটি স্থানে ট্রাকে করে পাঁচটি নিত্যপণ্য বিক্রি করা হচ্ছে।
প্রতি কেজি দেশি চিনি ৫৫ টাকা, প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ৮৫ টাকা, ছোলা প্রতি কেজি ৭০, মসুর ডাল (মাঝারি সাইজ) ৫৫ ও খেজুর ১২০ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। একজন ক্রেতা প্রতিদিন সর্বোচ্চ চার কেজি চিনি, চার কেজি মসুর ডাল, পাঁচ লিটার সয়াবিন তেল, পাঁচ কেজি ছোলা ও এক কেজি খেজুর কিনতে পারবেন।
রাজধানীতে সচিবালয়ের গেট, জাতীয় প্রেসক্লাব, কাপ্তান বাজার, ভিক্টোরিয়া পার্ক, সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়, নিউমার্কেট অথবা নীলক্ষেত মোড়, শ্যামলী অথবা কল্যাণপুর, জিগাতলা মোড়, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, উত্তরা, মিরপুর-১ নম্বর মাজার রোড, শান্তিনগর বাজার, মালিবাগ বাজার, বাসাবো বাজার, আইডিয়াল স্কুল বনশ্রী, বাংলাদেশ ব্যাংক চত্বর, মহাখালি কাঁচাবাজার, শ্যাওড়াপাড়া বাজার, দৈনিক বাংলা মোড়, শাজাহানপুর বাজার, ফকিরাপুল বাজার ও আইডিয়াল জোন, মতিঝিল বক চত্বর, খিলগাঁও তালতলা বাজার, রামপুরা বাজার, মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর, আশকোনা হাজি ক্যাম্প, মোহাম্মদপুর টাউন হল কাঁচাবাজার, দিলকুশা, মাদারট্যাক নন্দিপারা কৃষি ব্যাংকের সামনে ও পলাশী মোড়ে টিসিবির পণ্য পাওয়া যাবে।
এছাড়া ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার ১৮৪টি স্থানে এবং টিসিবির নিজস্ব ১০টি খুচরা বিক্রয়কেন্দ্রে ও পরিবেশকের কাছ থেকেও ভোক্তারা এসব পণ্য কিনতে পারবেন।