ভুটান কি ক্রমেই চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে? কূটনৈতিক মহলে এই প্রশ্ন নতুন করে আলোচনায় আসছে। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং সম্প্রতি বেলজিয়ামের সংবাদপত্র ‘লা লিবরে’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে যা বলেছেন, তাতে ভারতের ভ্রুকুঞ্চন হয়েছে।
আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া না জানালেও ধারণা করা হচ্ছে, চীনের প্রবল চাপ সহ্য করা সম্ভবত ভুটানের পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। সে কারণে আগের অবস্থান থেকে তারা সম্ভবত কিছুটা পিছিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে।
লোটে শেরিং সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ডোকলাম সমস্যা সমাধানের দায় শুধু ভুটানের নয়। এখানে তিনটি দেশ রয়েছে। সেই দেশের কেউই বড় বা ছোট নয়। সবাই সমান। আমরা প্রস্তুত। অন্য দুই দেশ রাজি হলেই এ নিয়ে আলোচনা শুরু হতে পারে।’
ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে একটা বিষয় পরিষ্কার, ডোকলাম সমস্যার সমাধানে তারা ভারতের সঙ্গে চীনকেও সমান গুরুত্ব দিচ্ছে। চীনকে উপেক্ষা করে তারা কিছু করতে চাইছে না।
ডোকলামের বাটাং লা এলাকায় ভারত, ভুটান ও চীন—তিন দেশেরই সীমান্ত রয়েছে। এই এলাকার উত্তরে চীনের চুম্বি উপত্যকা। পশ্চিম প্রান্তে ভারতের সিকিম। দক্ষিণ ও পূর্বে ভুটানের অবস্থান। চীনের দাবি, প্রকৃত ত্রিদেশীয় সীমান্ত বাটাং লার সাত কিলোমিটার দক্ষিণে জিপমোচি শৃঙ্গ ও ঝাম্পেরি পাহাড়ি অঞ্চল। চীনের এই দাবি ভারত কখনো মানেনি। শুধু তাই নয়, ওই অঞ্চল চীনের নয়, ভুটানের—এই দাবিও ভারত জোরের সঙ্গে জানিয়ে আসছে।
চীন কেন জিপমোচি-ঝাম্পেরি এলাকা দাবি করছে, ভারতের কাছে তা পরিষ্কার। ওই এলাকায় চীন ঘাঁটি গাড়তে পারলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের সঙ্গে একমাত্র সংযোগকারী এলাকা পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি করিডরের ওপর তারা সরাসরি নজর রাখতে পারবে।
কৌশলগত কারণে যা চীনের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণেই ২০১৭ সালে সৃষ্টি হয়েছিল ডোকলাম সংকট। ওই এলাকা বরাবর চীন পাকা সড়ক তৈরির চেষ্টা করলে ভারতীয় সেনাবাহিনী রুখে দাঁড়িয়েছিল। উত্তেজনা ছড়িয়েছিল ডোকলামে।
ভারতীয় বাহিনীর প্রতিরোধে চীন শেষ পর্যন্ত পিছু হটে। পরে ভারত দাবি করে, ভুটানের দিকে অবৈধভাবে ঢুকে চীন অনেক নির্মাণকাজ চালাচ্ছে। বেশ কিছু উপগ্রহ ছবিতেও তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল।
ভুটানের প্রধানমন্ত্রী অবশ্য এই সাক্ষাৎকারে ‘অবৈধ নির্মাণকাজের’ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘ভুটানের জমিতে কেউ কোনো রকম অবৈধ নির্মাণকাজ চালাচ্ছে না। আমাদের আন্তর্জাতিক সীমান্ত কোথায় ও কতটা, তা আমরা ভালো করেই জানি।’
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই সাক্ষাৎকার নিয়ে এখনই কোনো মন্তব্যে রাজি নয়। আনুষ্ঠানিকভাবে তাই কিছু বলা হয়নি। কিন্তু বিষয়টি ভারতকে ভাবাচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের এক সূত্রের মতে, ভুটানের এই প্রধানমন্ত্রীই ২০১৯ সালে বলেছিলেন, ত্রিদেশীয় সীমান্তে একতরফাভাবে কিছু করা তিন দেশের কারও-ই উচিত নয়।
কূটনৈতিক মহলের ধারণা, ডোকলাম–পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ ভুটানের ভূরাজনৈতিক উপলব্ধিতে সম্ভবত কিছুটা পরিবর্তন এনেছে।
চীনের সঙ্গে এখনো তাদের আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। ভারতের প্রতি সবদিক থেকে নির্ভরশীল হলেও চীনের প্রবল উপস্থিতি তারা উপেক্ষা করতে পারছে না। সেই কারণে ত্রিদেশীয় সীমান্ত সমাধানে তিন পক্ষের সহমত হওয়ার ওপর ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং জোর দিয়েছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সূত্রের মতে, ভবিষ্যৎ ঘটনাপ্রবাহ যে দিকেই গড়াক না কেন, বাটাং লার সাত কিলোমিটার দক্ষিণে ত্রিদেশীয় সীমান্ত পেছানোর চীনা দাবি মেনে নেওয়া ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়।