শুধু গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে নয়, বিএনপি এখন যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সব শরিককে নিয়ে একটি ঘোষণাপত্র দিতে চাইছে। কারণ, এককভাবে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বিএনপির যৌথ ঘোষণাপত্র দেওয়ার ব্যাপারে আপত্তি তুলেছে অন্য শরিকেরা।
সে জন্য গণতন্ত্র মঞ্চ ঘোষণাপত্রের খসড়া দিলেও বিএনপি তা চূড়ান্ত করতে আরও সময় চেয়েছে। বিএনপি নেতারা বলেছেন, গণতন্ত্র মঞ্চ ঘোষণাপত্রের যে খসড়া দিয়েছে, তা নিয়ে আন্দোলনে থাকা সব দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা করে অল্প সময়ের মধ্যে চূড়ান্ত করা হবে।
সাতটি দলের জোট গণতন্ত্র মঞ্চ যুগপৎ আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে বিএনপির সঙ্গে একটি ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ দিতে চেয়েছিল। গণতন্ত্র মঞ্চ ঘোষণাপত্রের খসড়া নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনাও করছে দুই মাস ধরে।
সর্বশেষ গত রোববার বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের লিয়াজোঁ কমিটি বৈঠক করেছে। সেই বৈঠকে বিএনপি আন্দোলনে থাকা অন্য শরিকদের নিয়ে সবাই মিলে একটি ঘোষণাপত্র দেওয়ার কথা বলেছে বলে জানা গেছে।
অন্য শরিকদের আপত্তি কেন
বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চ সূত্রে জানা যায়, এককভাবে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বিএনপি যৌথ ঘোষণাপত্র দিক, তা চাইছে না অন্য শরিকেরা। মূলত তাদের আপত্তির কারণেই গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে যৌথ ঘোষণাপত্র দিতে দেরি হচ্ছে। গণতন্ত্র মঞ্চের দেওয়া খসড়া ঘোষণাপত্রের অধিকাংশ বিষয়ের সঙ্গে লিয়াজোঁ কমিটিতে থাকা বিএনপির সদস্যরা একমত হওয়ার পরও দীর্ঘ সময়ে দলটি তাদের সিদ্ধান্ত জানায়নি।
১২–দলীয় জোট ও আন্দোলনের অন্য শরিকেরা মনে করছে, গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বিএনপি যদি এককভাবে কোনো যৌথ ঘোষণাপত্র দেয়, তাতে আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অন্য শরিকদের মধ্যে প্রশ্ন উঠতে পারে। এ ছাড়া গণতন্ত্র মঞ্চের তৈরি করা ঘোষণাপত্রের অনেক বক্তব্য নিয়ে অন্য শরিকদের সঙ্গে আদর্শিক দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে।
কিন্তু কোনো একটি জোটের সঙ্গে বিএনপির যৌথ ঘোষণাপত্র দেওয়ার ব্যাপারে যুগপৎ আন্দোলনের অন্য শরিকেরা যে আপত্তি তুলেছে, তা নিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের দলগুলো নিজেরাও আলোচনা করেছে। এই জোটের নেতারা বলছেন, যুগপৎ আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে একটি ঘোষণাপত্রের প্রয়োজন রয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন। সে কারণে তাঁরা একটি ঘোষণাপত্র দিতে চাইছেন।
পুরোনো ও নতুন মিত্রদের দ্বন্দ্ব
বিএনপির পুরোনো শরিকদের সবাই গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে এককভাবে ঘোষণাপত্র দেওয়ার বিরোধিতা করছে। পুরোনো ও নতুন মিত্রদের মধ্যে দ্বন্দ্ব যাতে বেড়ে না যায়, সে জন্য বিএনপি যৌথ ঘোষণাপত্রের বিষয়ে পুরোনো শরিকদের কথাও শুনবে। আর শরিক সব দল ও জোটকে নিয়েই এখন এই ঘোষণাপত্র দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে দলটি।
অবশ্য গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা রাষ্ট্রসংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম প্রথম আলোকে বলেন, আন্দোলনের একটা যৌথ ঘোষণাপত্রের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি গণতন্ত্র মঞ্চই তুলে ধরে। কেউ যদি ভাবেন, এটি বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের ঘোষণা, সেটি ভুল হবে। কাউকে বাদ দিয়ে নয়। আন্দোলনে থাকা সবার ন্যূনতম দাবিগুলো একত্র করে মাঠে নামার জন্যই এ ঘোষণাপত্র।
গত ৩০ ডিসেম্বর গণমিছিলের কর্মসূচি দিয়ে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন দল ও জোট যুগপৎ কর্মসূচি পালন শুরু করে। প্রথম কর্মসূচির আগেই বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের ভিত্তি চূড়ান্ত করতে চেয়েছিল গণতন্ত্র মঞ্চ। সেটি না হওয়ায় দ্রুত তা করতে চেয়েও পারা যায়নি। বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের লিয়াজোঁ কমিটি এ বিষয় নিয়ে গত দুই মাসে কয়েকবার সভা করলেও ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত হয়নি।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ, দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ বেশ কিছু দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে একাধিক জোট। গণতন্ত্র মঞ্চ ছাড়াও রয়েছে ১২–দলীয় জোট ও ১১ দলের জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট। এর বাইরে এলডিপি ও গণফোরাম (মন্টু) নিজেদের মতো করে যুগপৎ কর্মসূচি পালন করছে।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন দীর্ঘদিনের ২০–দলীয় জোট ভেঙেই মূলত ১২–দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট হয়েছে। এই দুই জোটের অধিকাংশ দল দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির সঙ্গে রয়েছে। যুগপৎ আন্দোলনেও তারা কর্মসূচি পালন করছে। তাদের তুলনায় গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বিএনপির সখ্য নতুন। সূত্র জানায়, পুরোনো সঙ্গীরা চাইছে, শুধু গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে যেন বিএনপি ঘোষণাপত্র না দেয়। তারা বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করে।
গত রোববার লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক শেষে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, চলমান আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। শিগগিরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের যৌথ ঘোষণাপত্র দেওয়া হবে। যৌথ ঘোষণার ভিত্তি হবে একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।
যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপি ১০ দফা এবং রাষ্ট্রমেরামত বা সংস্কারের ব্যাপারে ২৭ দফা প্রস্তাব করেছে। আর গণতন্ত্র মঞ্চের দাবি এবং সংস্কারের রাজনৈতিক কর্মসূচি মিলিয়ে দিয়েছে ১৪ দফা। সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে যেসব দাবি এবং রাষ্ট্রসংস্কারের ব্যাপারে রাজনৈতিক প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, প্রস্তাবগুলো সমন্বয় করেই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করা হচ্ছে বলে বিএনপির নেতারা বলছেন।
গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘোষণাপত্র নিয়ে বিএনপি তাদের পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করবে। আন্দোলনে থাকা সবাই যেন নিজেকে এ ঘোষণাপত্রের অংশ মনে করতে পারে। এই ঘোষণাপত্রকে জাতীয় ঘোষণায় রূপ দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে দ্রুত ঘোষণাপত্র হওয়া প্রয়োজন।
আন্দোলন যুগপৎ হলেও কর্মসূচি ঘোষণার আগে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শরিকদের সঙ্গে আলোচনা করে না বিএনপি। অনেকটা এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে বাকিদের তা জানিয়ে দেয় দলটি। এই অভিযোগে যুগপৎ আন্দোলনের অন্যতম শরিক গণতন্ত্র মঞ্চ ১ এপ্রিল বিএনপি ঘোষিত কর্মসূচি পালন করেনি। এ বিষয়েও লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়।
তবে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে আমাদের কোনো ছন্দপতন নেই। অনেক কর্মসূচি আছে, যেগুলো যার যার দল থেকে করতে পারে, আবার গণতন্ত্র মঞ্চের ব্যানারেও করতে পারে। মূল দাবি, অর্থাৎ এই সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত করা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আমরা একত্র রয়েছি।’