ক্ষীণ একটা আশা ছিল, ১২ বছর পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর পারস্পরিক সম্পর্কের শীতলতা কিছুটা হলেও কাটাতে পারে। সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) গোয়া সম্মেলন নিয়ে তাই আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। শঙ্কাও যে ছিল না, তা-ও নয়।
মাত্র চার মাস আগে জাতিসংঘের আসরে যিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ‘গুজরাটের কসাই এখনো জীবিত’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন, সেই তরুণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি ভারতে দাঁড়িয়ে নতুন কোনো বিতর্ক সৃষ্টি করেন কি না, শঙ্কা ছিল তা নিয়েও। শীতলতা কাটা তো দূরের কথা, দুই দিনের সম্মেলনের অবসরে ভারত-পাকিস্তানের দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পারস্পরিক চাপান-উতোর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে নজিরবিহীন হয়ে রইল।
সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে বিলাওয়াল ও পাকিস্তানকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর যেভাবে আক্রমণ করলেন, তাতে স্পষ্ট, অদূরভবিষ্যতে তলানি থেকে সম্পর্কের ভেসে ওঠার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। বিলাওয়ালকে তিনি ‘সন্ত্রাসবাদ শিল্পের প্রচারক, ব্যাখ্যাকার ও মুখপাত্র’ বলে অভিহিত করে বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ দমনের প্রশ্নে পাকিস্তানের বিশ্বাসযোগ্যতা তাদের বিদেশি মুদ্রা সঞ্চয়ের ভান্ডার নিঃশেষ হওয়ার চেয়েও দ্রুত বিলীন হচ্ছে।’
সম্মেলন শুরুর আগেই ভারত বুঝিয়ে দিয়েছিল, বহুপক্ষীয় সংগঠনের সদস্য হিসেবে যতটুকু প্রাপ্য, পাকিস্তানকে সেটুকু মর্যাদাই দেওয়া হবে। তাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় কোনো পার্শ্ব বৈঠকে ভারত বসবে না। আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনার সময় তাই দেখা যায়, নমস্কার বিনিময় ছাড়া জয়শঙ্কর-বিলাওয়ালের মধ্যে কোনো বাক্যালাপ হলো না। জয়শঙ্করের শরীরী ভাষাও বুঝিয়ে দিল, সম্পর্ক সেই একই তিমিরে।
চাপান-উতোর শুরু জয়শঙ্করের ভাষণ থেকে। এসসিওর সনদে সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলা করার কথা বলা আছে মনে করিয়ে দিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সন্ত্রাসবাদের কোনো যুক্তি নেই। সন্ত্রাসবাদের যত রূপ ও প্রকার আছে, প্রতিটি কড়া হাতে দমন করা উচিত। এমনকি সীমান্তপারের সন্ত্রাসও।’
সীমান্তপারের সন্ত্রাসের লক্ষ্য স্পষ্টতই পাকিস্তান। এ সন্ত্রাসের কথা ভারত বলে আসছে কয়েক দশক ধরে। গত শুক্রবার এসসিওর আসরে জয়শঙ্করের এই প্রসঙ্গ অবতারণার অন্য কারণ হয়ে দাঁড়ায় কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণে পাঁচ জওয়ানের মৃত্যুর খবর।
জয়শঙ্করের তোলা সন্ত্রাসবাদের জবাব বিলাওয়াল দেন তাঁর ভাষণে। সন্ত্রাসবাদের সম্মিলিত মোকাবিলার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘এই বিপদ গোটা বিশ্বের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। আমি এই প্রসঙ্গের অবতারণা করছি সন্ত্রাসবাদী আক্রমণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবেই শুধু নয়, সন্ত্রাসবাদী আক্রমণে নিহত এক মায়ের (বেনজির ভুট্টো) পুত্র হিসেবেও।’ এরপরেই ভারতের নাম না করে বিলাওয়াল বলেন, ‘কূটনৈতিক জয়ের লক্ষ্যে সন্ত্রাসবাদকে হাতিয়ার করা থেকে সবার বিরত থাকা উচিত।’
এসসিও সম্মেলনের অবসরে বিলাওয়াল ভারতের একাধিক প্রচারমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেন। নিজের দেশের সাংবাদিকদের জন্য সংবাদ সম্মেলনও করেন। তিনি জানিয়ে দেন, বন্ধ বাক্যালাপ শুরুর চেষ্টা পাকিস্তানে যাঁরা চালিয়ে গেছেন, তাঁদের চরম অসুবিধার মধ্যে ফেলে দিয়েছে ২০১৯ সালে কাশ্মীর বিভাজন ও ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ। তাঁর মন্তব্য, ‘আলোচনার জন্য অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টির দায় ও দায়িত্ব এখন ভারতেরই। কাশ্মীর নিয়ে একতরফাভাবে গৃহীত সিদ্ধান্ত পূর্বাবস্থায় না ফিরলে পাকিস্তানের নীতি পরিবর্তন সম্ভব নয়।’
গতকাল শুক্রবার বিকেলে বিলাওয়াল একটি বিবৃতিও দেন। তাতে শান্তি স্থাপনে দুই দেশের একত্রে বসা ও সচেষ্ট হওয়ার কথা বলা হয়।
বিলাওয়াল গোয়া ছেড়ে যাওয়ার পর জয়শঙ্কর সংবাদ সম্মেলনে তাঁকে তুলাধোনা করেন। বিলাওয়াল সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন শুধু পাকিস্তানের সাংবাদিকদের জন্য। জয়শঙ্কর অন্য সবার সঙ্গে পাকিস্তানের সাংবাদিকদেরও আহ্বান জানান। সেখানে বিলাওয়ালের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, ‘সন্ত্রাসের শিকার ও মদদদাতা কখনো একসঙ্গে বসে সন্ত্রাস নিয়ে আলোচনা করতে পারে না। আমরা এক নৌকার যাত্রী নই।’
বিলাওয়ালের অভিযোগের জবাবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সন্ত্রাস হাতিয়ার করার অর্থ কী? কে করছে? তা ছাড়া হাতিয়ার করার মানে হয় হাতিয়ারকে মান্যতা দেওয়া। আমরা কী করছি? নিজেদের রক্ষা করছি শুধু। কূটনৈতিক জয়ের জন্য নয়। আমরা রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে পাকিস্তানের স্বরূপ গোটা পৃথিবীর কাছে উন্মোচিত করছি।’
সংবাদ সম্মেলনে এক পাকিস্তানি সাংবাদিক জানতে চান, বিলাওয়ালের সফরে বরফ গলবে কি না? জবাবে জয়শঙ্কর বলেন, ‘তিনি এসসিও সদস্য দেশের প্রতিনিধি হিসেবে এসেছিলেন। এর চেয়ে বিন্দুমাত্র বেশি কিছু নয়।’ ৩৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে বিলাওয়ালের মন্তব্য সম্পর্কে তিনি তাঁর উদ্দেশে বলেন, ‘ঘুম থেকে উঠুন। কফির কাপে চুমুক দিন। ৩৭০ এখন ইতিহাস।’
প্রচারিত বিবৃতিতে বিলাওয়াল বলেছেন, ‘শান্তিই আমাদের নিয়তি।’ তার জবাবে জয়শঙ্কর বলেন, ‘সেটা সত্যি কি না, জানি না। তবে এটা বিলক্ষণ জানি, সন্ত্রাসবাদ আমাদের নিয়তি হতে পারে না। শান্তির বাণীর পাশাপাশি সন্ত্রাসে মদদ একসঙ্গে চলতে পারে না। অথচ তারা (পাকিস্তান) এই খেলাই খেলে যাচ্ছে।’
এসসিও প্রতিরক্ষামন্ত্রী সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সশরীর যোগ দেননি। তিনি ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে অংশ নেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্মেলনে বিলাওয়াল এলেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের তিক্ততা স্পষ্টতই বৃদ্ধি পেল। চলতি বছরের জুলাইয়ের ৩ ও ৪ দিল্লিতে বসছে এসসিও শীর্ষ সম্মেলন। এই কাদা-ছোড়াছুড়ির পর সেখানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সম্ভাব্য উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে জন্ম হলো নতুন আগ্রহের।