• শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৩:৩৪ অপরাহ্ন

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তে আমানত হারাচ্ছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বাড়ছে

নিউজ ডেস্ক
আপডেটঃ : সোমবার, ৫ জুন, ২০২৩

বাংলাদেশ ব্যাংক (ফাইল ছবি)

ব্যাংকের চেয়ে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে (এনবিএফআই) আমানত রাখলে বেশি সুদ পাওয়া যায়, দীর্ঘদিন ধরে এমন ধারণাই প্রচলিত। কিন্তু এখন পরিস্থিতি একেবারেই উল্টো। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে গ্রাহকদের আমানতে বেশি সুদ দিচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মের বেড়াজাল ও মূল্যস্ফীতির চাপের কারণে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নতুন আমানত পাচ্ছে না। অন্যদিকে আর্থিক এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে জেঁকে বসা অনিয়ম দুর্নীতি গ্রাহকদের টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত করছে। এর ফলে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনা অনেকটাই চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বেলায় ‘বিমাতাসুলভ আচরণ’ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এদের সব ধরনের আমানতে সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা ৭ শতাংশ নির্ধারণ করে দিলেও ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের সর্বোচ্চ কোনও সীমা নেই, বরং সর্বনিম্ন সীমা রয়েছে। একই বাজারে কারও জন্য সর্বোচ্চ সীমা, আবার কারও জন্য সর্বনিম্ন সীমা থাকাতেই জটিলতা তৈরি হয়েছে। সুদহার কম হওয়ায় বিভিন্ন এনবিএফআই থেকে নিজেদের টাকা তুলে নিচ্ছেন সাধারণ গ্রাহক, করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক। আবার কেউ কেউ মেয়াদ শেষ হলে আর তা নবায়ন করছেন না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, মেয়াদি আমানতের সর্বনিম্ন সুদহার তিন মাসের মূল্যস্ফীতির কম হবে না। তারল্য-সংকট ও মূল্যস্ফীতি বাড়ায় অনেক ব্যাংক এখন মেয়াদি আমানতের সুদহার বাড়িয়ে ৯ শতাংশ পর্যন্ত করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এখন ব্যাংকগুলো আমানতের বিপরীতে ৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে, সেখানে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দিতে পারছে সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ। এর ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা তুলে সবাই বিভিন্ন ব্যাংকে রাখছে। এতে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় কমে যাচ্ছে আমানতের পরিমাণ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন তারল্য সংকটে ভুগছে। লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) খাজা শাহরিয়ার বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ৭ শতাংশের বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। যে কারণে এখন জমার চেয়ে বেশি টাকা নগদায়ন হচ্ছে। সাধারণ গ্রাহকদের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোও ৮ থেকে ৯ শতাংশের কম সুদে টাকা দিতে চাইছে না। এতে প্রতিষ্ঠান চালাতে বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান বাংলা বলেন, ব্যাংকের আমানতের ওপর বেঁধে দেওয়া সুদহারের সীমা তুলে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ভোক্তাঋণের ক্ষেত্রে সুদহার ১২ শতাংশ পর্যন্ত নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতের সুদ হারের সীমা তুলে দেওয়ার বিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী আগামী বৈঠকে এই বিষয়টি তোলা হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

নাম প্রকাশ‌ না করে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহী বলেন, তিনি যেসব প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণ বিতরণ করেছেন বৈশ্বিক সংকট বিশেষ করে ডলার সংকটে কারণে সেই প্রতিষ্ঠান এখন ঠিকমতো চলতে পারছে না। ফলে বিতরণ করা ঋণের টাকা সময়মতো ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না। আবার ব্যাংকগুলোর চেয়ে তাদের এখানে সুদের হার কম হওয়ার কারণে তারা আমানতও পাচ্ছেন না। ফলে একটা জটিল পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।

চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি ব্যাংকের আমানতের ওপর বেঁধে দেওয়া সুদহার তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন থেকে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার নিজেরাই নির্ধারণ করতে পারছে।

এর আগে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ব্যাংকগুলোর ঋণে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদহার নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরবর্তী ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতে সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ এবং ঋণে সর্বোচ্চ ১১ শতাংশ সুদহারের সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। মহামারি করোনা পরবর্তী এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের মূল্যস্ফীতির হার অস্বাভাবিক বাড়লে ২০২৩ সালে এসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নির্দেশনা মেনে চলতে গিয়ে চাপে পড়েছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।

সাধারণত এনবিএফআইগুলো সর্বনিম্ন তিন মাস মেয়াদে টাকা জমা নিতে পারে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারণ মানুষের আমানতের চেয়ে ব্যাংকের আমানত বেশি থাকে। দেশের বেশিরভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে কম সুদে টাকা নিয়ে গ্রাহকদের বেশি সুদে ঋণ দিয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনাকে কেন্দ্র করে এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকের আমানত পাচ্ছে না, আবার সাধারণ গ্রাহকরা টাকা রাখতে আগ্রহী হচ্ছে না।

রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক থেকে একটি এনবিএফআই সাড়ে ৮ শতাংশ সুদে ২০ কোটি টাকা আমানত নিয়েছিল। সেটির মেয়াদ শেষ হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে ৭ শতাংশ সুদ দেওয়ার প্রস্তাব করলে ব্যাংকটি রাজি হচ্ছে না। আবার তহবিল সংকটের কারণে সোনালী ব্যাংককে আমানতের টাকা ফেরত দিতেও পারছে না। একইভাবে সব সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদে এনবিএফআইগুলোতে টাকা জমা রেখেছে। এরমধ্যে যেসব আমানতের মেয়াদ শেষ হচ্ছে, তা নবায়ন ও নগদায়ন নিয়ে জটিলতা দেখা দিচ্ছে। কারণ, এনবিএফআইগুলোর ৭ শতাংশের বেশি সুদ দেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

একটি এনবিএফআইয়ের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই এক নির্দেশনার কারণে ভালো-খারাপ সব এনবিএফআই নিয়ম না মানার তালিকায় (নন-কমপ্লায়েন্স) পড়ে গেছে।

এদিকে বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার সংশ্লিষ্ট চারটি এনবিএফআইয়ের কারণে পুরো খাতটি আস্থার সংকটে পড়েছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এখন কড়া নজরদারি শুরু করেছে ও নতুন নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করছে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ