ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ও এডিস মশার আবাসস্থল ধ্বংসের লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ব্যাপকভাবে ওষুধ ছিটানো ও অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। ২০১৯ সালের ২৮ আগস্ট হাইকোর্টের (বর্তমানে আপিল বিভাগ থেকে অবসর) বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন। ওইদিন এডিস মশা নিধন ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মালয়েশিয়ার কথা উল্লেখ করে আদালত বলেন, ‘প্রয়োজনে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত এক বা দুদিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে সব শ্রেণির মানুষকে সঙ্গে নিয়ে একযোগে অভিযান পরিচালনা করা যেতে পারে।’
তবে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কোনো অবহেলা আছে কি না, থাকলে সে দায় কার, মশা নিয়ন্ত্রণে কার কী দায়িত্ব ছিল- এসব তদন্তে কমিটি গঠনের বিষয়ে সেদিন কোনো আদেশ দেননি হাইকোর্ট। এছাড়া এ ব্যাপারে তখন গণমাধ্যমের ভূমিকার ব্যাপক প্রশংসাও করেছিলেন উচ্চ আদালত। তবে ওই নির্দেশনার পরে এ রিটের আর কোনো অগ্রগতি নেই।
মশার উপদ্রব ও রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে এর আগেও বেশ কয়েকবার নির্দেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় বায়ুদূষণ রোধে নীতিমালা প্রণয়নের জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠনেরও নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। বায়ুদূষণ রোধে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং আর কী কী উপায়ে বায়ুদূষণ রোধ করা যায়, সে ব্যাপারেও সুপারিশের আদেশ দেওয়া হয়েছিল কমিটিকে। ওই আদেশের পর বায়ুদূষণ রোধে কাজ চললেও মশার উপদ্রব কমাতে ঢাকা উত্তর সিটির চেয়ে দক্ষিণ সিটি কম কাজ করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এডিশ মশা ও ডেঙ্গু রোধে পরিবেশবাদী ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) জনস্বার্থে এক সম্পূরক আবেদন করেছিল। ওই আবেদনের শুনানি শেষে ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই হাইকোর্টের বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ বেশে কিছু নির্দেশনা দেন। সেসময় রুলও জারি করেন আদালত। ওই নির্দেশনার পর এ সংক্রান্ত গঠিত কমিটি উচ্চ আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছিল। কিন্তু ২০২০ সালের পরে এর আর কোনো অগ্রগতি নেই।
এডিশ মশা নিধন ও ডেঙ্গু নিয়ে জনস্বার্থে রিট করেন এইচআরপিবি চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। তিনি বলেন, মশা নিয়ে অনেক আগে থেকেই গণমাধ্যম ও উচ্চ আদালত তৎপর। মশার উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় কয়েক বছর আগে আমরা একটি রিট পিটিশন করেছিলাম। এরপর আদালত সংশ্লিষ্টদের প্রতিবেদন দিতেও বলেছিলেন। পাশাপাশি আরেক আদালত স্বপ্রণোদিত (সুয়োমোটো) হয়ে আদেশ দিয়েছিলেন। এর পরে আমাদের ওই রিট মামলা থেকে সুয়োমোটোতে ট্রান্সফার হয়ে গেছে। এরপর বেশ কিছু আদেশ এবং তদন্ত কমিটিও হয়েছিল। তবে পরে আর কোনো কিছু হয়নি। যদিও গত বছর বিমানবন্দরের মশা নিধনের নির্দেশনা চেয়ে রিট করা হয়েছিল। এ নিয়ে একটি রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। ওই বিষয়ে বেশ কিছু আদেশ দিয়েছেন আদালত, তার অগ্রগতিও হয়েছে।
এডিস মশা নিধনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) কার্যক্রম বেশি উল্লেখ করে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, তারা (ডিএনসিসি) কিন্তু বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে, র্যাব নিয়েও অভিযানে গেছে। মশার লার্ভা যেখানে পাওয়া গেছে তাদের জরিমানা করছে। অভিযানও চলছে। কিন্তু এখন দেখতে হবে সিটি করপোরেশন যে মশার ওষুধ দিচ্ছে তা কার্যকরী কি না। সংশ্লিষ্টদের গবেষণা করা দরকার যে মশার ওষুধে কাজ হচ্ছে কি না। যদি কাজ হতো তাহলে তো এত ডেঙ্গু আক্রান্ত হতো না।
সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে এডিস মশা ধরন পাল্টেছে। এ বিষয়ে ডিএনসিসির উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম মোস্তফা সারওয়ার বলেন, এরই মধ্যে গবেষণায় প্রমাণিত যে এডিশ মশা এখন নোংরা পানিতেও ডিম পাড়ে। যেমন কোনো নির্মাণাধীন বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ড, যেখানে বেজমেন্টে পানি জমে নোংরা হয়ে আছে- ওখানে আমরা মাশার লার্ভা পাচ্ছি।
এডিশ মশা ও ডেঙ্গু নিয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার বিষয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম মোস্তফা সারওয়ার বলেন, স্কুল-কলেজ বন্ধ করে না, আমরা স্কুল-কলেজের প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তারা যেন শিক্ষার্থীদের সতর্ক করতে কাজ করেন। আমরা নিজেরাও বিভিন্ন স্কুল-কলেজে যাচ্ছি। কোথায় জন্ম হয় এডিশ মশার এবং কী কী করলে ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে- এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীদের জানাচ্ছি। পাশাপাশি সিটি করপোরেশন থেকে নিয়মিত মশার ওষুধও ছিটাচ্ছি।
ডিএনসিসির পরামর্শক ও গবেষক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ঢাকার ভেতরে ডেঙ্গুতো আছেই, ঢাকার বাইরের পরিস্থিতিও ধীরে ধীরে খারাপ হচ্ছে। দিন দিন তা আরও খারাপ হবে। কারণ, ঢাকায় মশা নিধনসহ সচেতনতা সৃষ্টিতে কিছু কার্যক্রম হয়। কিন্তু ঢাকার বাইরে তো এডিশ মশা ও ডেঙ্গু নিয়ে চোখে পাড়ার মতো কোনো কাজ নেই।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমাতুল করীম বলেন, যত স্মার্ট সিটি চিন্তা করেন কোনো লাভ হবে না, যদি না এখানকার মানুষ সচেতন না হয়। মশা ও ডেঙ্গু নিয়ে কাজ করার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আছে, সিটি করপোরেশন আছে- কিন্তু সেই জায়গায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পূর্বশর্ত নাগরিক সচেতনতা। আমরা সচেতন না হলে মশার ওষুধ ছিটিয়েও কিছু হবে না।
মশা নিধনে আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নের বিষয়ে ডিএনসিসির উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, উত্তর সিটির প্যানেল ল’ইয়ার আছেন তিন-চারজন। এ বিষয়ে ল ডিপার্টমেন্ট জানে।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের নানা উদ্যোগের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা নতুনভাবে কাজ হাতে নিয়েছি, কল সেন্টারের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি ফোন করছি। এটা গত এক সপ্তাহ ধরে চলছে। প্রতিদিন গড়ে এক লাখ লোককে নক করবো বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই মুহূর্তে একটি কল সেন্টারের মাধ্যমে এক হাজারের মতো বাড়িতে প্রতিদিন কল করা হচ্ছে। সেটি বাড়িয়ে এক লাখে উন্নীত করবো। আরও একটি বিষয় হলো রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিকে সঙ্গে নিয়ে আমরা কাজ করবো। তাদের স্বেচ্ছাসেবকরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে সচেতন করতে কাজ করবে। কারণ, আমাদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের তো সব বাড়ি যাওয়া সম্ভব নয়। স্বেচ্ছাসেবকদের ওয়ার্ডভিত্তিক ভাগ করে দেবো। মূলকথা হলো জনমনে সচেতনতা বাড়ানো।
মশা নিয়ন্ত্রণে দায় নিয়ে প্রশ্ন ছিল হাইকোর্টের
সময়মতো মশার কার্যকর ওষুধ না কেনার দায় সরকার এড়াতে পারে না বলে মন্তব্য করেছিলেন হাইকোর্ট। ২০১৯ সালের ২৬ আগস্ট বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন। ওইদিন আদালত এডিস মশা নিধনে ওষুধ আনার প্রক্রিয়া ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
এর আগে ওই বছরের ১৪ জুলাই আদালত এক আদেশে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা জানাতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির মেয়র, নির্বাহী কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য সচিব, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে নাগরিকদের ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়াসহ এ ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়া বন্ধ করতে এবং এডিস মশা নির্মূলে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত। এরপর ২২ জুলাই মশার বিষয়ে দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। কিন্তু ওই প্রতিবেদনে আদালত অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং দুই সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের তলব করেন। পরে তারা ২৫ জুলাই সশরীরে হাজির হয়ে আদালতে ব্যাখ্যা দেন।
আদালতের নির্দেশনার পর কয়েক বছর কেটে গেলেও এ বিষয়ে খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। চলতি বছরও রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে ভয়াবহ আকারে। জুলাই মাসের মাঝামাঝিতে হঠাৎ করেই বেড়ে যায় ডেঙ্গুর প্রকোপ। এর আগে মশার উপদ্রব বাড়লেও সিটি করপোরেশনের কার্যকর কোনো উদ্যোগ ছিল না বলে অভিযোগ নগরবাসীর।