বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার (আইডিআরএ) কঠোর হস্তক্ষেপে দীর্ঘ প্রায় আড়াই বছর পর বীমা দাবির টাকা পেল যমুনা গ্রুপ। মঙ্গলবার আইডিআরএ’র সম্মেলন কক্ষে বেসরকারি খাতের ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স ২৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকার পে-অর্ডার হস্তান্তর করে। এ সময় দাবির টাকা পূরণে বিলম্ব হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেন বীমা কোম্পানিটির চেয়ারম্যান এনামুল হক।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান সাবেক সচিব মো. শফিকুর রহমান পাটোয়ারী, আইডিআরএ’র সদস্য গকুল চাঁদ দাস, বোরহান উদ্দিন আহমেদ এবং ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এএমএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। যমুনা গ্রুপের পক্ষ থেকে যমুনা ইলেকট্রুনিক্স অ্যান্ড অটোমোবাইলসের অগ্নি বীমা দাবির পে-অর্ডার গ্রহণ করেন গ্রুপের জিএম (কমার্শিয়াল) এবিএম শামসুল হাসান। চেক হস্তান্তর অনুষ্ঠানে আইডিআরএ’র পক্ষ থেকে বলা হয়, দেশে বীমা খাতের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। আর এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বীমা কোম্পানিগুলোকে গ্রাহকের দাবি পূরণে আরও সক্রিয় হতে হবে। এক্ষেত্রে এ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবহিদিতা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে আইডিআরএ। ফলে আগামী দিনে আরও গতিশীল হবে এ খাত।
আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান বলেন, দেশের বীমা খাতে স্বচ্ছতা বাড়ছে। আগামীতে এ খাতে আরও গতি আসবে। এক্ষেত্রে আইডিআরএ তার সীমিত জনবল দিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আইডিআরএ’র জনবল বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। ফলে বীমা কোম্পানির প্রতি নজরদারি বাড়ানো যাবে। তিনি বলেন, অনেকটা বিলম্ব করলেও ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স বীমা দাবির প্রায় ২৪ কোটি টাকা আজ (মঙ্গলবার) পরিশোধ করেছে। আইডিআরএ’র মাধ্যমে এ দাবি পূরণ হওয়ায় বীমা খাতের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল। শফিকুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, এ দাবি পূরণ পুরো বীমা খাতের জন্য একটি মেসেজ। বীমা কোম্পানিগুলোকে উপলব্ধি করতে হবে, গ্রাহকের দাবি যৌক্তিক হলে অব্যশ্যই তারা তা পরিশোধে বাধ্য।
গকুল চাঁদ দাস বলেন, যমুনা গ্রুপ দেশের একটি বৃহৎ শিল্প গ্রুপ। সময়মতো বীমা দাবি বুঝে না পেলেও প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার সাহসের সঙ্গে তার ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত দাঁড় করাতে পেরেছেন। কিন্তু সাধারণ কোনো ব্যবসায়ী হলে তিনি কোনোভাবেই সে ব্যবসা চালু করতে পারতেন না। তিনি বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্যে বলেন, আপনাদের মনে রাখতে হবে, যথাসময়ে বীমা দাবি পরিশোধ করতে হবে। যেন আমাদের কাছে কাউকে না আসতে হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
তিনি বলেন, বীমা খাতের উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করছে আইডিআরএ। কিন্তু এ খাতের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়াতে সংশ্লিষ্ট সবার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি জরুরি। বিশেষ করে গণমাধ্যমকে এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। গণমাধ্যমের উদ্দেশে তিনি বলেন, সব খাতে ভুলত্রুটি রয়েছে। বীমা খাত এর ঊর্ধ্বে নয়। ফলে কোনো নেতিবাচক সংবাদ পেলে তা প্রকাশে আপত্তি নেই। আমরা মনে করি, গণমাধ্যম এ খাতের ভুল ধরিয়ে দিয়ে কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করছে। তবে এর পাশাপাশি দেশের বীমা শিল্পের স্বার্থে ইতিবাচক সংবাদও প্রকাশ করতে হবে। না হলে এ শিল্পের বিকাশ সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বীমা শিল্পের জন্য আইডিআরএ’র জন্ম। সেজন্য সব সময়ই প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। আগামীতেও গ্রাহকের স্বার্থের ব্যাপারে কোনো আপস নেই।
ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স চেয়ারম্যান এনামুল হক তার বক্তৃতায় বলেন, ‘যমুনা গ্রুপের বীমা দাবির টাকা কেন এতদিন দেয়া হয়নি, সে প্রসঙ্গে আমি যাব না। আমি বলব, আমাদের দোষের কারণে সময়মতো ক্লেইম দেয়া হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘কেউ কেউ চেষ্টা করেছিল রিট করে সময়ক্ষেপণের পথ বেছে নিতে। কিন্তু আমি বলেছি, না। যদি ক্লেইম সঠিক হয়, তাহলে ওদিকে যাব না। আমি টাকা পরিশোধ করব। জানতে পেরেছি, বীমা দাবি সঠিক, তাই আজ আইডিআরএ’র ডাকে সাড়া দিয়ে পুরো টাকা পরিশোধ করতে এখানে এসেছি।’ তিনি বলেন, যমুনা একটি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ। আমরা তাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী। বীমা দাবির টাকা পরিশোধে বিলম্বের জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের কোম্পানি সেক্রেটারি শেখ আনোয়ার উদ্দিন, প্রধান হিসাব কর্মকর্তা শিমুল কান্তি বড়ুয়া, অবলিখন বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা কাজী সাখাওয়াত হোসেন, বীমা দাবি বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শামসুদ্দিন আহমদ প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, আইনের বাধ্যবাধকতা মেনেই ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সে বীমা পলিসি করে যমুনা ইলেকট্রুনিক্স অ্যান্ড অটোমোবাইলস। ২০১৪ সালের ৩ মার্চ থেকে ২০১৫ সালের ৩ মার্চ পর্যন্ত মেয়াদে এ পলিসির আকার ছিল ৫০ কোটি ৮ লাখ টাকা। এরপর ২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরে যমুনা ইলেকট্রুনিক্সে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে প্রতিষ্ঠানটির ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪০ কোটি টাকা। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতির হিসাব করার জন্য তিনটি সার্ভেয়ার নিয়োগ দেয় ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স। ঘটনার ৬ মাস পর ওই বছরের ১৬ আগস্ট চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় সার্ভেয়াররা। প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ডের পর ১১ শতাংশ সেলভেজ (অবশিষ্ট পণ্যের দাম) দেখিয়ে ২৩ কোটি ৯৮ লাখ ১ হাজার ১৫ টাকা ক্ষতি নির্ধারণ করে সার্ভেয়ার প্রতিষ্ঠান। সার্ভে রিপোর্ট পাওয়ার দুই বছর ২ মাস পর আইডিআরএ’র সহায়তায় মঙ্গলবার বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়।
প্রসঙ্গত, স্বাভাবিক নিয়মানুযায়ী সার্ভে রিপোর্ট পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে বীমা দাবির টাকা পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স তা না করে দিনের পর দিন সময়ক্ষেপণ করে। সবচেয়ে নেতিবাচক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় প্রতিষ্ঠানটির সাবেক এমডি একেএম সারওয়ার্দী চৌধুরী। মূলত তার একগুঁয়েমি সিদ্ধান্তের কারণে বিষয়টি সময়মতো নিষ্পত্তি হয়নি। তিনি ভেবেছিলেন, বীমা দাবির টাকা না দিয়ে পার পেয়ে যাবেন। আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন একজন আইনজীবী। যার মদদে বিষয়টি আরও ঘোলাটে হয়। এমনকি আইডিআরএ যখন ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের মাধ্যমে বীমা দাবির বিষয়টি চূড়ান্ত হয়, তখনও ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের কতিপয় ব্যক্তি টাকা পরিশোধ না করে ভিন্ন পন্থা তালাশ করতে থাকেন। একপর্যায়ে আইডিআরএ কঠোর অবস্থান নিয়ে ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের লাইসেন্স বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে মঙ্গলবার বোর্ড মিটিং আহ্বান করে। এ অবস্থায় টাকা পরিশোধে সম্মত হয় ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স। এর আগে একটি চক্র মন্ত্রণালয়ে মাসের পর মাস ফাইল আটকে রেখে আইডিআরএ সদস্য নিয়োগের পথ বন্ধ করে দেয়। ফলে সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কোরাম সংকটের কারণে বোর্ড মিটিং করতে পারছিল না জনগুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু সব অপশক্তি শেষ পর্যন্ত পরাস্ত হয়। সম্প্রতি আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান সাবেক সচিব ও চৌকস কর্মকর্তা মো. শফিকুর রহমান পাটোয়ারী। এরপর একে একে সব জট খুলতে থাকে। এছাড়া বীমা দাবির এ টাকা আদায়ে আগে থেকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন সদস্য গকুল চাঁদ দাস।