সরকারের পদত্যাগ, ভোট বর্জন ও ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে লিফলেট বিতরণ করেছে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। গত ২৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া লিফলেট বিতরণের এই কর্মসূচি শেষ হচ্ছে আজ শনিবার। এরপরই নির্বাচন ঘিরে কঠোর আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি দেবে সরকারবিরোধী দলগুলো। মূলত নির্বাচনকে ভোটারবিহীন প্রমাণে নানামুখী কর্মসূচির ছক তৈরি করা হয়েছে।
বিএনপি ও সমমনা একাধিক দলের সূত্র মতে, নির্বাচন প্রতিহতের নামে কর্মসূচি পালনের বিষয়ে দলগুলোর অনেক নেতার আপত্তি আছে। এজন্য সে অনুযায়ী চ‚ড়ান্ত আন্দোলনের জন্য ছক প্রস্তুত করা হয়েছে। এতে নরম গরম দুই ধরনের কর্মসূচিই থাকবে। হরতাল-অবরোধের কর্মসূচির বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা হয়েছে। তবে নামের কিছুটা ভিন্নতা থাকতে পারে। গণহরতাল, গণকারফিউ, গণলকডাউন এমন ধরনের নামে কর্মসূচি দেওয়ার বিষয়ে দলগুলোর শীর্ষ ফোরামে আলোচনা হয়েছে।
বিএনপির প্রভাবশালী এক নেতা জানান, ভোটের আগে ও পরের কর্মসূচির বিষয়ে যুগপৎ আন্দোলনে শরিক ও আন্দোলনের মাঠে সমমনা জামায়াতে ইসলামীসহ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়েছে। সব দলের মতামত নিয়ে শুক্রবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটি বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। শনিবার স্থায়ী কমিটির বৈঠক হবে। সেখানেই কর্মসূচি চ‚ড়ান্ত হবে।
বিএনপি-জামায়াত সূত্র জানায়, নতুন বছরের প্রথম ৬ দিনই হরতাল-অবরোধ থাকবে। নির্বাচনের দিন ‘গণকারফিউ’ নামে কর্মসূচিও ঘোষণা করার পরিকল্পনা রয়েছে। আন্দোলন সফল করতে ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে বিএনপি-জামায়াতের যৌথ ‘বিশেষ কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। গোপনীয়তা রক্ষা করে চলছে প্রতিনিয়ত সিরিজ বৈঠক।
স¤প্রতি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক সূত্র মতে, কঠোর ও গণসংযোগ দুই ধরনের কর্মসূচিই থাকবে। এর মধ্যে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত হরতাল-অবরোধ-গণকারফিউ থাকছে। এরপর নির্বাচন বাতিলের দাবিতে কর্মসূচি শুরু হবে। যা পুরো জানুয়ারি মাসব্যাপী চলবে।
সূত্র মতে, কঠোর অবরোধের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে ‘ভোট বর্জনের’ গণসংযোগের কর্মসূচির বিষয়েও ভাবা হচ্ছে। নির্বাচনকে ভোটারবিহীন প্রমাণ করতে নানা উদ্যোগও রয়েছে। মূলত আন্তর্জাতিক মহলের সামনে নির্বাচনকে ‘একতরফা’ ও ‘ভোটারবিহীন’ প্রমাণ করতে চায় বিরোধী দলগুলো। এ লক্ষ্যে জনগণকে ভোটদানে নিরুৎসাহিত করতে তারা প্রচার চালাবে। এর অংশ হিসেবে গত কয়েকদিন ধরে লিফলেট বিতরণের মতো গণসংযোগ কর্মসূচি চলছে। এর বাইরে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলছে প্রচারণা। দু-এক দিনের মধ্যে ভোটবিরোধী স্টিকার তৈরি করবে বিএনপি। ওইসব স্টিকার যানবাহন, বিভিন্ন স্থাপনা এবং হাটবাজারে লাগানো হবে। হাজার হাজার স্টিকার লাগানো হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভোটের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে শুরু হয়েছে ব্যাপক প্রচার।
বিএনপি ও সমমনাদের লিফলেট বিতরণ
এদিকে দ্বিতীয় দফায় গণসংযোগের চতুর্থ দিন শুক্রবার ঢাকাসহ সারা দেশে লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি পালন করেন দলগুলোর নেতাকর্মীরা। একই দাবিতে পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গণসংযোগকালে ভোটারদের উদ্দেশে নেতারা বলেন, ৭ জানুয়ারি দেশপ্রেমিক জনগণ ভোট কেন্দ্রে যাবে না। ‘ডামি মার্কা’ নির্বাচনে জনগণের কোনো সমর্থন নেই। সরকার রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে একতরফা নির্বাচনের উৎসব করছে। দেশের মানুষের অধিকারকে খর্ব করছে আওয়ামী লীগ। তারা গণতন্ত্রকে বিশ্বাস করে না। কাউকে বিশ্বাস করতেও দেয় না। সারা দেশে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছে।
দুপুরে রাজধানীর গুলশানে লিফলেট বিতরণ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান। ৭ জানুয়ারি ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে না যাওয়ার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, একতরফা ডামি নির্বাচনে ভোট কেন্দ্র না গিয়ে আপনারা পরিবার-পরিজনকে সময় দিন। ভোট বর্জন করুন। গণতন্ত্র উদ্ধারে বিএনপির অসহযোগ আন্দোলন জোরদার করুন।
জনগণের উদ্দেশে সেলিমা রহমান বলেন, দেশের স্বাধীনতা চলে যাচ্ছে, এটাই মনে রাখবেন। বাংলাদেশের পতাকা আটকে যাবে যদি এটা (নির্বাচন) হয়। ৪০ জন দিয়েছে ‘ভারতের প্রার্থী’। আমার দেশ, আমরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি, আর ‘ভারতের প্রার্থী! এদেশ আর থাকবে না। একটা স্বাধীন রাষ্ট্রে এগুলো হয়? আপনারা মুখ খোলেন।’
এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিএনপি নেত্রী তাহসিনা রুশদী লুনা, শিরিন সুলতানা, রাশেদা বেগম হিরা, রেহানা আকতার রানু, শাম্মি আক্তার, ফরিদা ইয়াসমিন, বীথি ইসলাম, আয়শা সিদ্দিকা মনি প্রমুখ।
সেগুনবাগিচা এলাকায় গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক। এ সময় তিনি বলেন, ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে যে নাটক মঞ্চস্থ করা হবে তাতে দেশের শতভাগ মানুষের সমর্থন নেই। আর একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এবং রাজনৈতিক দলগুলো যেন নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে সেজন্য সরকারের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন এই নাটক মঞ্চস্থ করছে। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন তাঁতী দলের সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক ডক্টর কাজী মনিরুজ্জামান, যুগ্ম আহবায়ক গোলাপ, মোস্তফা কামাল, শাখাওয়াত হোসেন আশিক প্রমুখ।
সকালে ধানমন্ডি এলাকায় লিফলেট বিতরণ করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। এ সময় তার সঙ্গে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. মো. রফিকুল ইসলাম, সহ-অর্থনৈতিক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সুমন, তাঁতী দলের আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ। নির্বাচন বর্জন ও সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে লিফলেট বিতরণ করেছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। দিনের বিভিন্ন সময়ে এই কর্মসূচি পালন করেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। ধানমন্ডিতে লিফলেট বিতরণ করেন ছাত্রনেতা কেএম সাখাওয়াত হোসেন, সাজ্জাতুল হানিফ সাজ্জাদ, সালেহ মো. আদনান, আবুল কালাম আজাদ সুমন, মিলন হাওলাদার প্রমুখ। ফকিরাপুল এলাকায় লিফলেট বিতরণ করেন ছাত্রনেতা মো. রাকিবুল ইসলাম রাকিব, অলিউজ্জামান সোহেল, মাকসুদা রিমা প্রমুখ। ঢাকা জজ কোর্ট ও জনসন রোডের বিভিন্ন এলাকায় লিফলেট বিতরণ করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) ছাত্রদল। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সভাপতি আসাদুজ্জামান আসলাম ও সাধারণ সম্পাদক সুজন মোল্লা, জুলকার নাইন, শামিম হোসেন প্রমুখ।
সমমনা জোট ও দল:সকালে মগবাজার এলাকায় গণসংযোগ ও প্রচারপত্র বিতরণ করেছে ১২ দলীয় জোট। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) নওয়াব আলী আব্বাস খান, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামী বাংলাদেশের ডক্টর গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম প্রমুখ। এদিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পৃথকভাবে লিফলেট বিতরণ করেছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এডিপি, রেজা কিবরিয়ার নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদ, বাংলাদেশ লেবার পার্টিসহ অন্যান্য সমমনা দল।
জামায়াতের লিফলেট বিতরণ:নির্বাচন বর্জন, ভোটারদের ভোটদান থেকে বিরত, বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন প্রত্যাখ্যান এবং দেশের হারানো গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এই কর্মসূচি পালন করেন দলটির নেতাকর্মীরা।