সহীহ বুখারীর একটি হাদিস, হযরত আবু মূসা (রা.) বর্ণনা করেন : রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে যখন কোনো সাহায্যপ্রার্থী আসত, কিংবা তাঁর কাছে কোনো প্রয়োজনের কথা বলা হতো, তিনি তখন (উপস্থিত সাহাবীদের) বলতেন, তোমরা (তার পক্ষে) সুপারিশ কর, তাহলে তোমরা পুরস্কৃত হবে। আর আল্লাহ যা চান, তাঁর নবীর জবানে সেই ফয়সালাই করাবেন। (সহীহ বুখারী : ১৪৩২)।
এ হাদিসটিতে গত আলোচনার আলোচ্য বিষয়টি আরও সুস্পষ্টরূপে দৃশ্যমান। রাসূলূল্লাহ (সা.) এখানে বলছেন, অভাবী-অসহায় কেউ যখন আসে তোমরা তার পক্ষে সুপারিশ করো। সুপারিশ করলেই যে সেটা গৃহীত হবে এমন নয়। কিন্তু তোমাদের সুপারিশ গৃহীত হোক আর নাই হোক, তোমরা কোনো অবস্থাতেই এর সওয়াব ও প্রতিদান থেকে বঞ্চিত হবে না।
এ হাদিসের আরেকটি শিক্ষা-সুপারিশ করলেই যে তা গ্রহণ করতে হবে এমন নয়। সুপারিশ তো একটি পরামর্শ মাত্র, একটি অনুরোধ। সুপারিশকারী ভালো মনে করলে সুপারিশ করবেন, আর যার কাছে সুপারিশ করা হলো তিনি ভালো মনে করলে সে সুপারিশ গ্রহণ করবেন। কথা এতটুকুই। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের সুপারিশ তোমরা কর, আর আল্লাহ তাআলা যেটা চান, তিনি তাঁর নবীকে দিয়ে সেটাই ফয়সালা করাবেন।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুপারিশ যদি গ্রহণ করতেই হয়, সেটা সুপারিশকারীর ভয়েই হোক কিংবা তার ক্ষমতা ও দাপটের কারণেই হোক, তখন তা আর সুপারিশ থাকে না। এটাকে হয়তো ‘আদেশ’ বলতে হবে, কিংবা বলতে হবে ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’। এটা সুপারিশ নয়। সুপারিশকারীকে এমন উদার মানসিকতা নিয়েই সুপারিশ করতে হবে-আমার কথা তিনি রাখতেও পারেন, নাও রাখতে পারেন। সুপারিশ যদি গৃহীত না হয় তাহলে এ নিয়ে তার রুষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
উপযুক্ত স্থানে, সামর্থ্য থাকলে সুপারিশ করতে হবে। কিন্তু এমনটা ভাবা যাবে না- আমার সুপারিশ গ্রহণ না করা আমাকে অপমান করার নামান্তর। অবশ্য সুপারিশ গ্রহণ করতে যদি কোনো সঙ্কট না থাকে, তাহলে যথাসম্ভব সুপারিশকারীর কথা গ্রহণ করা উচিত। কারণ সুপারিশ সাধারণত কোনো সম্পর্কের ভিত্তিতেই করা হয়। এই সম্পর্কের কারণে সুপারিশকারী আশায় থাকে- আমার সুপারিশ হয়তো সে গ্রহণ করবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : মানুষদেরকে তাদের উপযুক্ত মর্যাদা দাও। (সুনানে আবু দাউদ : ৪৮৪৪)।
তাই একই বিষয়ের সুপারিশ যদি আগে-পরে দুই সময়ে দুইজন করে, আর প্রথম সুপারিশকারীর তুলনায় দ্বিতীয় সুপারিশকারীর সঙ্গে সম্পর্ক অধিক ঘনিষ্ঠ হয়, কিংবা দ্বিতীয়জন অধিক সম্মানিত-সম্ভ্রান্ত কেউ হন, তাহলে প্রথমজনের সুপারিশ অগ্রাহ্য করার পরও দ্বিতীয়জনের সুপারিশ গ্রহণ করা যেতে পারে। সবার সঙ্গে একই আচরণ করতে হবে, একজনের সুপারিশ অগ্রাহ্য করার কারণে সবারটাই অগ্রাহ্য করতে হবে- এটা জরুরি নয়।
সুপারিশ যখন করা হবে, তখন যার কাছে সুপারিশ করা হচ্ছে তার বিষয়টিও যত্নের সঙ্গে লক্ষ্য রাখতে হবে। সুপারিশ একটি পরামর্শ আর পরামর্শ প্রদান একটি আমানত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : যার কাছে পরামর্শ চাওয়া হয় সে তো আমানতদার। (জামে তিরমিযী : ২৮২৩)। আর আমানতদারির দাবি হচ্ছে, তার কাছে সুচিন্তিতভাবে যেটা ভালো মনে হবে সে সেভাবেই পরামর্শ দেবে। পরামর্শ দেয়ার সময় কল্যাণকামিতার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা অপরিহার্য। কল্যাণকামী মানসিকতা ছাড়া সঠিক পরামর্শ দেয়া সম্ভব নয়।
তাই কোনো অসহায় বা বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির জন্যেও যদি কারও কাছে সুপারিশ করতে হয়, সেখানেও লক্ষ্য রাখতে হবে-এ সুপারিশ রক্ষা করতে গিয়ে সে আবার বিপদে পড়ে কি না; তার কোনো নিয়ম লঙ্ঘন করতে হয় কি না; তার নীতি ও নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে কি না; তাকে পরবর্তীতে প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে কি না; তার সম্মান-মর্যাদা ও চারিত্রিক শুদ্ধতা আক্রান্ত হয় কি না; আমার সুপারিশের মর্যাদা দিতে গিয়ে তাকে অনাকাক্সিক্ষত কোনো পরিস্থিতির শিকার হতে হয় কি না; তার ধনসম্পদ কিংবা দ্বীন-ধর্ম এতে আবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায় কি না।
তাই চাকরি বা এজাতীয় কোনো সুপারিশের ক্ষেত্রে প্রথমেই ভেবে নিতে হবে-যার জন্যে সুপারিশ করা হচ্ছে সে এ পদের উপযুক্ত কি না; এ পদে সে নিযুক্ত হলে মালিকের কিংবা জনগণের জানমালের কোনো ক্ষতির আশঙ্কা আছে কি না। কারও জন্যে আর্থিক সহযোগিতার সুপারিশ করতে হলেও যথাসম্ভব জেনে নিতে হবে-বাস্তবেই সে অভাবগ্রস্ত কি না; এমন সহযোগিতা পাওয়ার সে উপযুক্ত কি না।
সুপারিশের মহান ফযিলত লাভ করতে হলে এসব মূলনীতি সামনে রেখেই সুপারিশ করতে হবে। অন্যথায় ধর্মীয় ও সামাজিক-উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি আমাদের আপদ হয়ে দাঁড়াবে। এ বিষয়ে তাই সচেতনতা ও সতর্কতার বিকল্প নেই।