জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ক্যাম্পাসে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। জড়িতদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবিতে ক্যাম্পাস এখন উত্তাল। ঘটনার পর থেকে দফায় দফায় মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যার পর ক্যাম্পাসে মশাল মিছিল বের হয়।
চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় জড়িত থাকার অপরাধে ছাত্রলীগ নেতাসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান, একই বিভাগের সাগর সিদ্দিকী ও হাসানুজ্জামান এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাব্বির হাসান। পরে তাদের আদালতে পাঠানো হয়।
আদালতের নির্দেশে তাদের তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া, অভিযুক্ত মোস্তাফিজকে ছাত্রলীগ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। হাসানুজ্জামান ও মোস্তাফিজুর রহমানকে ক্যাম্পাস থেকে অবাঞ্ছিত ও সনদ স্থগিত এবং মুরাদ হোসেনকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট। এ ছাড়া সাগর সিদ্দিকী ও সাব্বির হাসান সাগরকে অবাঞ্ছিত, সাময়িক বহিষ্কার, সনদ প্রদান স্থগিত করা হয়েছে।
জানা যায়, অন্যতম অভিযুক্ত মামুনুর রশীদ ওই দম্পতির পূর্ব পরিচিত ও একই বাসায় থাকতেন। গত শনিবার সন্ধ্যায় প্রথমে ভুক্তভোগী নারীর স্বামীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মোশাররফ হলে ডেকে আনেন মামুন। একপর্যায়ে তাকে ‘এ’ ব্লকের ৩১৭ নম্বর কক্ষে জিম্মি করেন অভিযুক্তরা। পরে মামুন বাসায় রেখে আসা জিনিসপত্র জিম্মির স্ত্রীকে দিয়ে হলে নিয়ে আনার জন্য বাধ্য করেন।
সে অনুযায়ী ওই নারী মামুনের জিনিসপত্র নিয়ে রাত সাড়ে ৯টার দিকে ক্যাম্পাসে আসেন। তখন সেগুলো বুঝে নেন মামুন। এরপর অভিযুক্তরা ওই নারীকে বলেন ‘তার স্বামী অন্য গেট (জঙ্গলের দিক) থেকে আসছেন’। তখন তাকে হল সংলগ্ন জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেন মোস্তাফিজ ও মামুন। ইতোমধ্যে ভুক্তভোগী নারী এই বক্তব্য পুলিশকে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস ও ট্রাফিক উত্তর বিভাগ) আবদুল্লাহ হিল কাফি।
তিনি বলেন, আলোচিত এই ঘটনায় আশুলিয়া থানায় একটি মামলা করেছেন ভুক্তভোগী নারীর স্বামী। মামলায় মোস্তাফিজ ও মামুনুর রশীদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়া বাকি চারজনের বিরুদ্ধে মারধর ও আসামিদের পালাতে সহায়তা করার অভিযোগ আনা হয়েছে। পলাতক মামুন ও মো. মুরাদকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
এদিকে, এ ঘটনায় অভিযুক্তদের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ঘটনার পর থেকে দফায় দফায় মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিকাল সাড়ে ৫টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান করছিলেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বিক্ষুব্ধরা ‘ক্যাম্পাসে ধর্ষক কেন, প্রশাসন জবাব চাই,’ ‘ধর্ষণমুক্ত ক্যাম্পাস চাই’ ‘ধর্ষকদের পাহারাদার, হুঁশিয়ার সাবধান’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন।
তাদের হাতে ধর্ষণ বিরোধী বিভিন্ন প্ল্যাকার্ডও দেখা গেছে। একই সঙ্গে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ শাস্তি গ্রহণের ব্যবস্থা করাসহ তিন দফা দাবি জানানো হয়েছে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নূরুল আলমের কাছে। আন্দোলনকারীদের তোপের মুখে ওইদিন বিকালে দাবিগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে জরুরি সিন্ডিকেট সভার ডাক দেন উপাচার্য। উত্থাপতি দাবিগুলো হলো- জাবি প্রশাসন বাদী হয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে, সব আবাসিক হল থেকে অবৈধ শিক্ষার্থীদের বের করতে হবে।
আন্দোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আনিছা পারভীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা যে তিনটি দাবি জানিয়েছি তা বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। আর দাবিগুলো যতদিন বাস্তবায়িত হবে না ততদিন আমাদের আন্দোলন চলবে।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নূরুল আলম বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দাবি তিনটি যৌক্তিক হওয়ায় সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য আমরা সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ইতোমধ্যে আশুলিয়া থানায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বাদী হয়ে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাকি দাবিগুলো শিগগিরই বাস্তবায়ন করা হবে।
জানা গেছে, গ্রেফতার হাসানুজ্জামান জাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও সাগর সিদ্দিকী ৪৬ ব্যাচের এবং সাব্বির হাসান সাগর বোটানি বিভাগের ৪৭ ব্যাচের। তারা সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ও শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। প্রধান অভিযুক্তদের পালাতে সহযোগিতা করার দায়ে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
সাময়িক বহিষ্কার ও সনদ স্থগিত: বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ধর্ষণকান্ডের ঘটনায় অভিযুক্তদের মধ্যে হাসানুজ্জামান ও মোস্তাফিজুর রহমানকে ক্যাম্পাস থেকে অবাঞ্ছিত ও সনদ স্থগিত এবং মুরাদ হোসেনকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট। এ ছাড়া সাগর সিদ্দিকী ও সাব্বির হাসান সাগরকে অবাঞ্ছিত, সাময়িক বহিষ্কার, সনদ প্রদান স্থগিত করা হয়েছে। এ ঘটনার অধিকতর তদন্তের জন্য চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল বিকালে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের জরুরি সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আসক’র উদ্বেগ এবং দ্রুত সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি: জাবি-তে ন্যক্কারজনক ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র-আসক। একই সঙ্গে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার জোর দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার এই সংগঠনটি। গতকাল আসক-এর নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এই ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে, অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে যাদের রুখে দাঁড়ানোর কথা, প্রতিবাদ করার কথা সেই যুবশক্তি বা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠেছে এবং নিজেরাই ধর্ষক হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। যা আমাদেরকে নতুন শঙ্কার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ছাত্র ইউনিয়নের বিবৃতি: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদ। গতকাল এক যৌথ বিবৃতিতে কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি দীপক শীল এবং সাধারণ সম্পাদক মাহির শাহরিয়ার রেজা এই দাবি জানান। তারা বলেন, জড়িত ছাত্রলীগ নেতাদের বিচার নিয়ে কোনো টালবাহানা করা হলে তা প্রতিহত করা হবে।