• বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১২:৫৭ অপরাহ্ন

মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে‘ তিমির বিনাশের’ বার্তা

নিউজ ডেস্ক
আপডেটঃ : রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২৪
মঙ্গল শোভাযাত্রা চারুকলা অনুষদ থেকে শুরু হয়ে টিএসসি এসে শেষ হয় ছবি: সংগৃহীত

অন্ধকারের শক্তিকে পরাজিত করে আলোর আহ্বান জানিয়ে এবারের বর্ষবরণ উৎসবের মঙ্গল শোভাযাত্রা শেষ হলো। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ‘আমরা তো তিমিরবিনাশী’। বর্ষবরণের প্রধান আকর্ষণ মঙ্গল শোভাযাত্রা এবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে বের করা হয়েছে।

রবিবার (১৪ এপ্রিল) ৯টা ১৫ মিনিটে মঙ্গল শোভাযাত্রাটি চারুকলার সামনে থেকে শুরু হয়। পরে শাহবাগ, ঢাকা ক্লাব ও শিশু পার্কের সামনে থেকে ইউটার্ন নিয়ে ৯টা ৫০ মিনিটে টিএসসিতে এসে শেষ হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালের নেতৃত্বে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম ও ডিএমপি কমিশনারসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।

এর আগে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে মঙ্গল শোভাযাত্রায় প্রদর্শনীর জন্য বিভিন্ন মুখোশ, পেঁচা, ঘোড়া, মূর্তি, ট্যাপা পুতুল, নকশি পাখি, বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি শোভাযাত্রার জন্য প্রস্তুত করা হয়। এ ছাড়া মাছ ও রাজা-রানির মুখোশ ছিল।

শোভাযাত্রায় অংশ নিতে শাহবাগ, টিএসসি এবং চারুকলা এলাকাজুড়ে বাঙালি সাজে হাজারো উৎসবপ্রেমী মানুষ ভিড় করতে থাকে। এ সময় অনেক বিদেশি নাগরিককেও দেখা গেছে।

শোভাযাত্রা ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ছিল বেশ তৎপর। শোভাযাত্রার শুরুতে র‌্যাবের মোটরসাইকেলের টহল টিম। পরের সাড়িতে ডিএমপি সোয়াটের সদস্যরা। এরপর পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা। শোভাযাত্রা ও এর আশপাশ এলাকা ছিল একাধিক ড্রোন। ওয়াচ টাওয়ার থেকেও পর্যবেক্ষণ করছিল পুলিশ। শোভাযাত্রার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কয়েক স্থরে ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তাবেষ্টনী।

এবারও মুখোশ ব্যবহার ও ভুভুজেলা বাজানো নিষিদ্ধ। নিরাপত্তার জন্য রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকায় কেন্দ্রীয় রাস্তা বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

শোভাযাত্রা চলাকালীন চারুকলা থেকে শাহবাগ মোড় সড়কে দুই পাশেও কয়েক হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে শোভাযাত্রা উপভোগ করেন। শাড়িতে নারী আর পাঞ্জাবিতে পুরুষ, এ যেন বাঙালিয়া সাজের এক রঙিন বাহার। আর তরুণ-তরুণীদের আগমনে গমগম করছিল পুরো প্রাঙ্গণ।

এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে ‘আমরা তো তিমিরবিনাশী’। এবার মঙ্গল শোভাযাত্রায় বাংলার লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপকরণ, গ্রামীণ জীবনের অনুষঙ্গ, পশুপাখি, ফুল—এসবের প্রতীক ও রকমারি মুখোশ বহন করা হয়। এবারও বড় আকারের চাকা, পাখি, ফুল, হাতি, বনরুইয়ের প্রতীক ছিল। আর ছিল বড় আকারের রাজা-রানি ও হাতে বহন করার জন্য ছোট আকারের প্যাঁচা, মাছ, পাখির শতাধিক মুখোশ।

প্রথমবারের মতো মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে অনেক উচ্ছ্বসিত ছিলেন ভারতীয় (কলকাতা) নাগরিক অংশুমান ভৌমিক। তিনি বলেন, ‘ঢাকার বুকে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান কেমন হয়! এ নিয়ে কলকাতায় বসে অনেক গল্প শুনেছি, অনেক কিংবদন্তি কথা শুনেছি। আজ তা প্রত্যক্ষ করছি। সকালে রমনা বটমূলে যে অনুষ্ঠান, তা এক কথায় বাঙালির গর্বের জায়গা। সেখানে থাকতে পেরে নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে করছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘প্রতিবছর মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের অনুপ্রাণিত করে। অন্ধকারকে কাটিয়ে আলোর পথে যাব, এটি আমাদের প্রত্যাশা। তরুণসমাজ মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। ‘তিমির বিনাশী’ স্লোগান অন্তরে ধারণ করে হবে অগ্রযাত্রা।’

এবারের আয়োজনে চারটি বড় মোটিফ বা শিল্পকর্ম তৈরি করা হচ্ছে জানিয়ে ঢাবি চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, ‘প্রতি বছরই আমরা আমাদের লোকজ মাটির পুতুল থেকে এসব মোটিফ তৈরি করি। চারটি মোটিফের মধ্যে রয়েছে পাখি, হাতি, ভোঁদর এবং চাকার মধ্যে চোখ নিয়ে ভিন্ন রকম একটি শিল্পকর্ম। যে মোটিফ তৈরি করা হয়েছে এগুলো আমাদের লোকজ জীবনে রয়েছে। সেগুলোকেই আমরা একটু বড় করে তৈরি করেছি। এছাড়া মুখোশসহ নানা রকম শিল্পকর্মও তৈরি করা হয়েছে।’

এবারের ঈদুল ফিতরেও ছুটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৈশাখী ছুৃটি। ফলে নগরীর সিংহভাগ বাসিন্দা গ্রামেই বৈশাখ বরণ করছে। এ কারণে এবছর বেশ সাচ্ছন্দে শোভাযাত্রা উপভোগ করেছে বলে জানান অনেকেই। শিল্পী রফিকুন্নবী বলেন, ‘এবার দুটো আনন্দ একসঙ্গে। ঈদের পরপরই বর্ষবরণ। আমরা আশা করি মানুষ দ্বিগুণ আনন্দে মেতে উঠেছে। এছাড়াও অনেকেই ঢাকার বাইরে বর্ষবরণ করায় ঢাকায় কিছুটা চাপ কমেছে।’

বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য বজায় রাখতে বিভিন্ন নাগরিক ও সামাজিক উদ্যোগগুলোর মতো ঘরে ঘরেও চলছে বৈশাখ বরণের আয়োজন। বাহারি রঙের পোশাকের সঙ্গে চলছে পান্তা-ইলিশ আর নানা মিষ্টান্নর আয়োজন। সেই সঙ্গে পেছনের দুঃখ, জরা আর গ্লানিকে হটিয়ে সুন্দর ও শুভ সময়কে স্বাগত জানাচ্ছে সবাই।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলা আমাদের গর্ব, বাংলা আমাদের ভাষা। এ সাংস্কৃতি বাঙালি জাতির অংহকার। মেঘের পরে সূর্য আর রাতের পরে দিন আসে। আর অন্ধকার ভেদ করে আলো আসুক। আমি মনে করি এই অন্ধকার বেশি থাকবে। এখন বিশ্বব্যাপী একটা অশান্তি চলছে। অবশ্যই সেই অশুভ শক্তি কেটে যাবে। আসবে আলোর দিগন্ত।’

বাঙালির ঐতিহ্য দেখতে হাজার মাইল দূর থেকে ইউরোপের চেকরি পাবলিক দেশের এক বিদেশি নাগরিক বিনায়েল মুখা এসেছেন ঢাকার মঙ্গল শোভাযাত্রা উপভোগ করতে। তিনি বলেন, ‘আমি এই শোভাযাত্রার অনেক গল্প শুনেছি। আজ সামনে থেকে দারুণভাবে উপভোগ করেছি। এই প্রথম সামনে থেকে দেখতে পেরে আমার খুবই ভালো লাগছে।’

শোভাযাত্রা পোস্টারে ‘রিকশা আর্ট’
মঙ্গল শোভাযাত্রা গবেষণা ও প্রসারকেন্দ্র আয়োজিত কর্মশালা এবং মুক্ত আহ্বানে পাওয়া গিয়েছিল ৩৬টি পোস্টার। যেখানে আশির দশকের বাংলা সিনেমা, সাংস্কৃতি, লোকজ ও বাংলার বিভিন্ন চিত্র। যা রিকশার পিছনে আট করা হতো। সে ঐতিহ্য ফুটে উটেছে এবারের বাংলা ১৪৩১ সালের শোভাযাত্রায়।

উল্লেখ্য, ১৯৮৯ সালে চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। সেবারই এ উৎসব সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়। এরপর থেকে বাংলা বর্ষবরণের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে এটি।

১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এ আনন্দ শোভাযাত্রা ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাম ধারণ করে। পরে ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি লাভ করে এ শোভাযাত্রা।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ