মেঘনা নদীর ২২ কিলোমিটার অংশ বরিশালের হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার পাশ দিয়ে প্রবাহিত। এই ২২ কিলোমিটার তীরে অসংখ্য টংঘর তুলে মাছঘাট স্থাপনের মাধ্যমে চলে ইলিশ ধরা ও বেচাবিক্রি। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরাই সব সময় এসব ঘাট নিয়ন্ত্রণ করেন। গত ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। এরপর এসব মাছঘাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন বিএনপি নেতারা। এরই মধ্যে তাঁরা স্থানীয় মৎস্য বিভাগের ওপর প্রভাব বিস্তার শুরু করেছেন।
এদিকে ইলিশের প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হবে। রোববার সচিবালয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। এ সময় মাছ ধরা, বিক্রি, বিপণন, মজুত ও পরিবহন নিষিদ্ধ থাকে। তবে বরিশালে দেশের সবচেয়ে বড় ইলিশের অভয়াশ্রম মেঘনা অববাহিকায় এ নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন নিয়ে এবারও শঙ্কায় আছেন জেলে ও মৎস্য বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তারা।
মৎস্য বিভাগ, জেলে ও মাছ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রজনন মৌসুমে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কখনোই মাছ শিকার বন্ধ করা যায়নি। বরং আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকে নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তা আরও বেড়েছে।
শত শত নৌকা, ট্রলারে মৌসুমি জেলেদের দিয়ে অবৈধভাবে মাছ ধরার নেতৃত্ব দিতেন হিজলা উপজেলা আওয়ামী লীগের তিন প্রভাবশালী নেতা। এখন মেঘনার তীরের ২২ কিলোমিটারজুড়ে অন্তত ১২৫টি মাছঘাটের নিয়ন্ত্রণ করছেন বিএনপি নেতারা। তাঁরা এবারও পুরোনো পদ্ধতিতে নিষেধাজ্ঞার সময় মা ইলিশ নিধনে তোড়জোড় শুরু করেছেন বলে জানিয়েছেন জেলেরা।
তাঁরা বলছেন, এই অভয়াশ্রমে প্রতিবছর নিষেধাজ্ঞার সময় কয়েক শ কোটি টাকার মা ইলিশ বেচাবিক্রি হয়। নিষেধাজ্ঞার সময় সবচেয়ে বড় মাছঘাট হিজলার জানপুরেই প্রতি রাতে অন্তত এক কোটি টাকার ইলিশ অবৈধভাবে বিক্রি হয়।
গবেষকেরা বলছেন, ইলিশ মূলত সারা বছরই ডিম দেয়। তবে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর—এই দুই মাসের চারটি অমাবস্যা-পূর্ণিমায় ডিম পাড়ে। এ সময় ইলিশ ধরা থেকে বিরত থাকার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে মা ইলিশ রক্ষা করা, যাতে তারা নিরাপদে নদীতে ডিম ছাড়তে পারে। এই ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর প্রতিবছর ২ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন জাটকা ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকে।
মৎস্য–বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই ধাপের এই নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশে ইলিশ উৎপাদন এক দশকের বেশি সময় ধরে বেড়েছিল। কিন্তু তিন বছর ধরে ইলিশ আহরণ কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। নদীদূষণ, নাব্যতা হ্রাস, সাগর মোহনায় নিষিদ্ধ জাল দিয়ে ঘিরে রাখাসহ বেশ কিছু কারণ থাকলেও নিষেধাজ্ঞার সময় ব্যাপকহারে মা ও জাটকা ইলিশ নিধন বন্ধ করতে না পারাকে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন জেলে ও গবেষকেরা।
জেলে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিষেধাজ্ঞার সময় হিজলা, মুলাদী, মেহেন্দীগঞ্জ ও চাঁদপুরের হাইমচর থেকে শুরু করে ভোলার তেঁতুলিয়া পর্যন্ত নদ-নদী, এর অববাহিকা ও শাখানদীগুলোয় কয়েক হাজার ছোট নৌকায় ইলিশ শিকার করা হয়। কিছু এলাকায় রাতের বেলা হাটও বসে। এসব হাট থেকে ইলিশ স্পিডবোট ও ট্রলারে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। মেঘনার তীরে এ রকম অন্তত ১২৫টি ঘাটে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার মা ইলিশ বেচাকেনা হয়।
১৫ বছর ধরে এই চক্রে নেতৃত্ব দিতেন হিজলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান মাহমুদ, সাধারণ সম্পাদক ও বড়জালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন হাওলাদার এবং সহসভাপতি ও হিজলা-গৌরবদী ইউপির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম। অবশ্য তাঁরা বারবার এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন। এবছর বিশাল সাম্রাজ্য চলে গেছে হিজলার বিএনপির তিন নেতার কবজায়। তাঁরা হলেন হিজলা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক গাফফার তালুকদার, সদস্য সচিব মনির দেওয়ান ও যুগ্ন আহবায়ক আলতাফ হোসেন ওরফে খোকন দপ্তরি। এরই মধ্যে বিএনপি নেতারা মৎস্য বিভাগের ওপর প্রভাব বিস্তার শুরু করেছেন। নিষেধাজ্ঞার মৌসুমে অভিযান চালানোর কাজে ব্যবহারের জন্য তাঁরা ট্রলার ও মাঝির তালিকা মৎস্য বিভাগে দিয়েছেন। প্রতিবছর অভিযানে ট্রলার দিতেন তিন আওয়ামী লীগ নেতা। এবছর তা দিতে যাওয়া হচ্ছে বিএনপির পক্ষ থেকে।
মৎস্য বিভাগ সূত্র ও জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিষেধাজ্ঞার সময় অভিযানে যে জাল ও মাছ উদ্ধার হয়, তার সিংহভাগ ভাগাভাগি করে নিতেন তিন নেতা ও তাঁদের অনুসারীরা। আর যেসব জেলে আটক হতেন, তাঁদের ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিয়ে এই খাতে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হতো। এবার বিএনপি নেতারা একই পন্থায় এমন সুযোগ নিতে মৎস্য বিভাগে অভিযানে ব্যবহারের জন্য ট্রলার ও মাঝিদের তালিকা দিয়ে তা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য চাপ দিচ্ছেন
হিজলা উপজেলা মৎস্য বিভাগের একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি জেলেদের পুনর্বাসনের জন্য ৩২টি গরু বরাদ্দ দেওয়া হয় হিজলায়। বিএনপির ওই তিন নেতা এসব গরু তাঁদের দিয়ে দেওয়ার জন্য উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আলমের ওপর চাপ দেন। মৎস্য কর্মকর্তা এতে অস্বীকৃতি জানান এবং চাপ সামলাতে না পেরে বরাদ্দ প্রত্যাহার করে পার্শ্ববর্তী মুলাদী উপজেলায় বিতরণের প্রস্তাব করেন। পরে মুলাদীতে সপ্তাহ দুয়েক আগে ওই গরু বিতরণ করা হয়।
হিজলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আলম বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন আমি বাধ্য হয়ে ওই নেতাদের চাপে এসব গরু পাশের উপজেলায় দেওয়ার জন্য প্রস্তাব করেছি। সে অনুযায়ী তা বিতরণও করা হয়েছে।’
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে হিজলা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক গাফফার তালুকদার বলেন, ‘এই অভিযোগ সত্য নয়। আমাদের ফোন করে মৎস্য কর্মকর্তা মতামত চেয়েছিলেন। তারপর কী হয়েছে, জানি না।’ নিষেধাজ্ঞার সময় মা মাছ ধরায় প্রস্তুতি বিষয়ে গাফফার তালুকদার বলেন, ‘আগে আওয়ামী লীগের তিন নেতার নেতৃত্বে এটা হতো। এখন তাঁরা নেই। আমরা সহযোগিতা করব। অভিযানের ট্রলারে তালিকা দিইনি। আমার ঘাটগুলোতে এসব করতে দেব না।’ এখন তো সেসব ঘাট আপনাদের দখলে—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমার কয়েকটি ঘাট আছে। আমার দলের অন্য নেতাদেরও আছে।’
অপর বিএনপি নেতা মনির দেওয়ান বলেন, ‘গরুর বরাদ্দ আমরা চেয়েছি, এটা সঠিক নয়। মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে আমরা সচেতনতামূলক সভা করছি। আশা করি, শতভাগ এবার কার্যকর হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হিজলার গৌরবদী-জানপুর এলাকার অন্তত ১৫ জন জেলে জানান, নিষেধাজ্ঞা ঘিরে অবৈধ মা মাছ শিকারের জন্য হিজলার জানপুরের ৩ নম্বর খালের মুখে কমপক্ষে আড়াই হাজার জেলে নৌকা থাকে। রাতে শরীয়তপুর ও ভোলার জেলেরা এখানে জড়ো হন। রাতভর মাছ ধরে তীরেই চলে বেচাকেনা। আশুলিয়া আবুপুরের অস্থায়ী হাটে শরীয়তপুর মাদারীপুরসহ বিভিন্ন এলাকার পাইকারেরা এই মাছ বেচাকেনা করেন।
হিজলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আলম বলেন, রোববার মন্ত্রণালযের সভায় তিনি অংশ নেন। সেখানে মেঘনা ঘিরে অভয়ারণ্য নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে। এবার অভিযান সফল করতে পাঁচটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন স্পিডবোট আনার ব্যবস্থা নিয়েছেন। প্রতিটি অভিযানে সেনা সদস্যদের উপস্থিতির ব্যাপারে অনুরোধ করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘হিজলা বিএনপির ওই তিন নেতা অভিযানে ট্রলার ও মাঝিদের তালিকা দিয়ে সেগুলো নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। তবে আমরা সরাসরি এটা না করে দিয়েছি। তবে এ ব্যাপারে সবার সহযোগিতা ছাড়া আমরা এ এলাকায় অভিযান সফল করতে পারব না।