ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত অনেকেই জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন জানিয়ে সংগঠনের নেতাদেরকে ‘গণহারে’ গ্রেফতারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন আন্দোলনকারী সংগঠনটির সমন্বয়ক সারজিস আলম। ছাত্রলীগ ট্যাগ দিয়ে এসব ছাত্রকে নিষিদ্ধের কাতারে ফেলার তিনি পক্ষপাতী নন বলে জানিয়েছেন।
সোমবার রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক পোস্টে তিনি এসব কথা বলেন।
সারজিস আলম লিখেছেন, ‘একটা বিষয়ে স্পষ্ট দ্বিমত প্রকাশ করতে চাই। বিষয়টা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে। যেহেতু অন্য ক্ষেত্র নিয়ে আমার ক্লিয়ার আইডিয়া নেই, তাই সেসব রিলেট না করার জন্য আহ্বান করছি।’
তিনি লেখেন, ১ জুলাইর পূর্বে এবং ১ জুলাই থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে আন্দোলন চলমান ছিল, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। এই আন্দোলনটা মেইনলি ১৫ তারিখ পর্যন্ত হলের ছেলে-মেয়েরাই নিয়ে গিয়েছে। যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা খুব ভালো করে জানেন, এখানে হলে থাকতে হলে অবশ্যই ছাত্রলীগ করতে হতো। তাদের প্রোগ্রাম, গেস্টরুম করতে হতো। গণরুমে থাকতে হতো। সেজন্য হলে যারা থাকতো তাদের অধিকাংশ এক প্রকার বাধ্য হয়েই এসব করতো।
এই সমন্বয়ক আরো লেখেন, ‘এবার আরেক প্রসঙ্গে আসি। হলের যে ছাত্রলীগের কমিটি হতো এখানে প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী কমিটিতে থাকতো কিছু কারণে-
যেমন-
১. ভালো একটা রুম বা সিট যেন পাওয়া যায়।
২.যেন চাকরি হওয়া পর্যন্ত হলে থাকা যায়।
৩. অন্যরা যেন তার ওপর অন্যায় না করে বা ট্যাগ না দেয়।
বাকি ২০ শতাংশের মধ্যে অনেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করতো, অনেকে ভিন্নমতের লোকদের ওপর অত্যাচার করতো, অনেকে ক্যান্ডিডেট হতো, অনেকে একটু ফাপর নিয়ে চলতো।
সারজিস লেখেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক এই প্রথম ধাপের ১৬-১৭ দিনের আন্দোলনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ওই ৮০ শতাংশ স্টুডেন্ট। তারা যেমন পোস্টেড ছিল, তেমনি হলের তুলনামূলক ক্লিন ইমেজ প্রভাব রাখা ফেইস ছিল। তারা হল থেকে ব্যানার নিয়ে আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে নেমেছিল বলেই আদার্স নন-পোস্টেড সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের সঙ্গে বের হয়ে আসতে পেরেছিল এবং এ কারণেই ক্যান্ডিডেটরা হল থেকে প্রোগ্রাম নিয়ে আন্দোলনে আসা আটকাতে পারেনি এই পোস্টেড ছেলেরা হল থেকে এক হয়ে বের না হলে নন-পোস্টেডরাও এক হয়ে বের হয়ে আসার সাহস করতে পারতো না। ওই গার্টস আর বোল্ডনেস এই ছেলেগুলাই শো করতে পারে।’
তিনি আরো লেখেছে, ‘হলের পার্সপেক্টিভে সত্য এটাই যে, এই পোস্টেড তুলনামূলক ক্লিন ইমেজের হলের ছেলেরা আন্দোলনে এসেছিল বলেই ১ জুলাই থেকে ১৫ জুলাই সম্ভব হয়েছিল এবং আন্দোলনটা প্রাথমিকভাবে অন্য কোনো দলের বা সরকারবিরোধী ট্যাগ দেওয়া যায়নি। ১৫ জুলাই পর্যন্ত আন্দোলন না আসলে ৫ আগস্ট কখনো সম্ভব হতো কি না সে বিষয়ে ঢের সন্দেহ আছে।’
“এখন প্রশ্ন হচ্ছে হলের এই পোস্টেড ছেলেগুলোকে আমি ছাত্রলীগ ট্যাগ দিয়ে নিষিদ্ধের কাতারে ফেলবো কি না। উত্তর: ‘ফেলবো না’। যারা ১ জুলাই থেকে আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজের জীবন বাজি রেখে রাজপথে ন্যায়ের পক্ষে নিজের অবস্থান জানান দিয়েছে তারা তাদের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। সত্য এটাই যে, এই আন্দোলন সফল না হলে এই ছেলেগুলোকেই সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হতো। বিশ্বাসঘাতক ট্যাগ দেয়া হতো,” যোগ করেন সারজিস আলম।
তিনি লেখেছে, ‘যে সিস্টেমের কারণে এদের বাধ্যতামূলক ছাত্রলীগের রাজনীতি করতে হয়েছে, পোস্ট নিতে হয়েছে সেই সিস্টেমের জন্য দায়ী হলে আপনাদের সবাইকে দায়ী হতে হবে। কারণ আপনারা চুপ ছিলেন। হলে, ক্যাম্পাসে দিনের পর দিন ওদের সঙ্গে হওয়া অন্যায়ে কেউ বাধা দেননি। ওরা যদি সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটির জন্য পোস্ট নেয় তবে আপনিও নিজের গা বাঁচাতে চুপ ছিলেন। বরং যখনই সুযোগ হয়েছে ওরা সাহস করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজপথে নেমে এসেছে। আর তখনও আপনি নীরব দর্শক হয়ে অনেক কিছু শুধু দেখে গেছেন।’
‘এই ৮০ শতাংশ ছেলের কেউ যদি পূর্বে কোনো অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত থাকে তবে তদন্তসাপেক্ষে তার শাস্তি হোক, কেউ যদি পরে কোনো অন্যায়ে জড়িত হয় তবে তদন্তসাপেক্ষে তারও শাস্তি হোক। কিন্তু যখন দরকার ছিল, তখন রাজপথে নামালাম আর এখন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের পোস্টেড দেখেই গণহারে গ্রেফতার হবে এটা কখনোই সমর্থন করি না। এটা হতে পারে না।
সবশেষে তিনি লেখেন, ‘যারা সময়ের প্রয়োজনে ন্যায়ের পক্ষে ছাত্রলীগের সব বাধা উপেক্ষা করে আমার সঙ্গে জীবনবাজি রেখে রাজপথে নেমেছে তারা আমার ভাই। ২৪ এর অভ্যুত্থানের যোদ্ধা। আমি তাদের পক্ষে থাকবো। সত্য সত্যই। কে কী বললো তাতে আমার কিছু যায় আসে না।