বিজ্ঞানের জগতে এমন কেউ নেই, যিনি বিজ্ঞানী নিল ডিগ্রেস টাইসনকে [Neil de-Grasse Tyson]- চিনেন না। টাইসন একজন মার্কিন জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী, বিশ্বতাত্ত্বিক, অনেকগুলো বেস্ট সেলার বইয়ের লেখক এবং জনপ্রিয় বক্তা। তিনি প্রায়ই ইসলাম নিয়ে কথা বলেন। তিনি খুব দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে, মুসলিমরা একসময়ে বিজ্ঞানে অনেক উন্নত ছিল, কিন্তু আজ বিজ্ঞানে মুসলিমদের দুর্দশা।
বিজ্ঞানী টাইসন বলেন, ‘আমরা এখন আকাশে যে নক্ষত্র ও তারাগুলো দেখি, সেগুলোর মধ্যে অসংখ্য তারকার নাম আরবিতে, কারণ মুসলিমরাই এগুলো আবিষ্কার করে এবং তারাই এগুলোর নাম দেন। গণিতশাস্ত্রে আমরা এখন যে আল-জেবরা (Algebra-বীজগণিত) শব্দটি ব্যবহার করি, এটি একটি আরবি শব্দ। কম্পিউটারের জন্যে আমরা যে অ্যালগরিদম (Algorithm) পরিভাষাটি ব্যবহার করি, এটিও একটি আরবি শব্দ এবং এগুলো মুসলিমদের-ই আবিষ্কার।
আমরা যে ১, ২, ৩, এসব নম্বর ব্যবহার করি, সেটিও আরবি নম্বর থেকে এসেছে। কেবল গণিত বা জ্যোতির্বিজ্ঞানে মুসলিমদের অবদান আছে, তা নয়, বরং রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, কৃষি, ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিক্যাল, এমনকি আধুনিক সময়ের নেভিগেশনসহ বিজ্ঞানের সকল শাস্ত্রে তখন এককভাবে মুসলিমদের-ই অবদান ছিলো।’ [সূত্র: বিজ্ঞানী টাইসনের একটি লেকচার। লিংক—
একই লেকচারে বিজ্ঞানী টাইসন আরো বলেন, ‘মুসলিমদের বিজ্ঞানে উন্নতির সময়টা ছিলো ৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১১০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, যা কেবল মুসলিমদের জন্যে নয়, বরং সমস্ত মানব জাতির জন্যে ছিলো একটি সোনালি যুগ। কিন্তু ১১০০ শতাব্দীর পরে মুসলিমরা তাদের সকল বৈজ্ঞানিক অর্জনকে হারিয়ে ফেলেছে।’ মুসলিমদের এই পতনের উদাহরণ দিতে গিয়ে বিজ্ঞানী টাইসন ১৯০০ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত মুসলিম ও ইহুদীদের একটি পরিসংখ্যান দেখান।
যেমন- পৃথিবীতে ইহুদীদের জনসংখ্যা মোট ১৫ মিলিয়ন। কিন্তু তাদের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির সংখ্যা হলো: বায়োমেডিক্যালে ১৯৬টির মধ্যে ৪৯টি। রসায়নে ১৫৮টির মধ্যে ২৮টি। পদার্থবিদ্যায় ১৮৯টির মধ্যে ৪৫টি। অর্থনীতিতে ৬৬টির মধ্যে ২৮টি। মোট ৬০৯টি নোবেল পুরস্কারের মাঝে ইহুদিরা পেয়েছে ১৫০টি পুরস্কার। অর্থাৎ, নোবেল পুরস্কারের ২৫% পুরস্কার পেয়েছে ইহুদিরা। অন্যদিকে পৃথিবীতে মুসলিমদের জনসংখ্যা মোট ১.৩ বিলিয়ন। কিন্তু তাঁদের নোবেল পুরস্কারের সংখ্যা হলো: বায়োমেডিক্যালে ১৯৬টির মধ্যে একটিও নেই। রসায়নে ১৫৮টির মধ্যে ১টি। পদার্থবিদ্যায় ১৮৯টির মধ্যে ১টি। অর্থনীতিতে ৬৬টির মধ্যে ২টি। মোট ৬০৯টি নোবেল পুরস্কারের মাঝে মুসলিমরা পেয়েছেন ৪টি পুরস্কার। অর্থাৎ, নোবেল পুরস্কারের ০.৫০% পুরস্কার পেয়েছেন মুসলিমরা।
বিজ্ঞানী টাইসন মুসলিমদের এই পতনের কারণ হিসাবে একজন ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করেন। তিনি হলেন ইমাম আবু হামিদ আল গাজালী। ১১০০ সালের দিকে ইমাম গাজালী নাকি বলেছেন—‘The manipulation of numbers is the work of the devil.’ অর্থাৎ, ‘সংখ্যা নিয়ে কাজ করা হলো শয়তানের কাজ।’ ইমাম গাজালী এটা বলার পর নাকি মুসলিমরা বিজ্ঞান ছেড়ে দিয়েছিলেন, এবং এতে করে নাকি মুসলিমদের পতন শুরু হয়েছিলো।
আসলে, বিজ্ঞানে মুসলিমদের ঐতিহ্য সম্পর্কে বিজ্ঞানী টাইসনের প্রথম কথাগুলো সঠিক হলেও শেষে এসে তিনি মুসলিমদের পতনের যে কারণটি দেখিয়েছেন, তা একেবারেই সত্য নয়। ইমাম গাজালী কখনো কোথাও বলেননি যে, ‘গণিত নিয়ে গবেষণা করাটা হলো শয়তানের কাজ’। বরং, ইমাম গাজালী তার ‘এহইয়া উলুমিদ্দিন’ বইয়ের জ্ঞান অধ্যায়ে বলেছেন—‘গণিত ও মেডিক্যাল সাইন্সের মতো যেসব জ্ঞান পৃথিবীর জন্যে কল্যাণকর, তা অর্জন করা ফরজে কিফায়া। সমাজের কাউকে না কাউকে এসব জ্ঞান অর্জন করতে হবে, এটা আবশ্যিক।’
অনেকে বলেন, ইমাম গাজালী নাকি ‘দার্শনিকদের ভ্রান্তি’ বইয়ে গণিত ও বিজ্ঞানের বিরোধিতা করেছিলেন। আসলে এটাও একটি মিথ্যা অভিযোগ। বরং ইমাম গাজালী তার সে বইয়ে গণিত, জ্যামিতি ও বিজ্ঞানের পক্ষে কথা বলেছেন। ইমাম গাজালী বলেছেন যে, ‘গণিত ও জ্যামিতির সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে দার্শনিকদেরকে অস্বীকার করা বা তাদের সাথে দ্বিমত করার কোনো মানে নেই।’ ইমাম গাজালী কখনোই গণিত কিংবা বিজ্ঞানের বিরোধিতা করেননি, বরং দার্শনিকদের কিছু ভ্রান্তির বিপরীতে তিনি দর্শনের এই বইটি লিখেছিলেন। সুতরাং, বিজ্ঞানী টাইসন মুসলিমদের পতনের কারণ হিসাবে যে ইমাম গাজালীকে দায়ী করেছেন, তা আসলে একেবারেই ভুল ও ভিত্তিহীন। (চলবে)