ঘুষের বিনিময়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগ দেওয়াসহ নানা রকম আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. হারুনুর রশিদ মোল্লাহর বিরুদ্ধে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম ব্যবহার করে তিতাস এমডি এই দুর্নীতি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগকে নির্দেশ দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা পেয়ে পেট্রোবাংলাকে এক মাসের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে চিঠি দিয়েছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, গাজীপুরের পিরুজালী এলাকায় অবস্থিত মেসার্স সিলভার নিট কম্পোজিট টেক্সটাইল লিমিটেডের কারখানায় বয়লার ও গ্যাসচালিত জেনারেটরের জন্য নতুন গ্যাস সংযোগের আবেদন করেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ওই আবেদনের ওপর নির্দেশনা দিয়ে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক লিখেছেন, ‘মন্ত্রী মহোদয়ের অফিস হতে প্রেরিত। আলাপ করবেন।’
ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নির্দেশনা-সংবলিত আবেদনটি তিতাসের গাজীপুরের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মোহাম্মদ সাইদুল হাসানকে পাঠানো হয়। বিষয়টি জানতে সাইদুল হকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। গ্যাস সংযোগের জন্য ওই আবেদনপত্রটি জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী বরাবর পাঠানো হলেও সেখানে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের কোনো সিল, স্বাক্ষর কিংবা নির্দেশনা নেই। ওই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার দপ্তর থেকেও কোনো ধরনের চিঠি কিংবা নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। এরপরও তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবেদনপত্রে মন্ত্রীর (প্রধানমন্ত্রীর) দপ্তরের কথা উল্লেখ করেছেন।
বিষয়টি নজরে আসার পর গত ২৯ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জ্বালানি বিভাগের সচিবকে চিঠি পাঠানো হয়। রূপালী মণ্ডল (পরিচালক-১১) স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে, বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রীর (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) নাম ব্যবহার করে উৎকোচ গ্রহণ করে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে তিতাস গ্যাসের সংযোগ প্রদানসহ নানা অনিয়মের বিষয়ে পরীক্ষা করে বিধি মোতাবেক যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিত করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের চিঠি পেয়ে বিষয়টি এক মাসের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য পেট্রোবাংলাকে নির্দেশ দিয়েছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ।
গত ১২ সেপ্টেম্বর জ্বালানি বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ ফারুক হোসেন স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশিদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে তিতাস গ্যাসের সংযোগ দেওয়াসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তোলা হয়।
চিঠি পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ ফারুক হোসেন।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব বরাবর পাঠানো এক অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, মন্ত্রী (প্রধানমন্ত্রী) কিংবা প্রতিমন্ত্রীর সুপারিশ না থাকা সত্ত্বেও উৎকোচ গ্রহণ করে সিলভার নিট কম্পোজিটের সঙ্গে এসএম এক্সেসরিজ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের গ্যাস সংযোগের ছয় মাসের পুরনো আবেদনটি দ্রুত পাস করিয়ে প্রতিষ্ঠান দুটিতে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়।
লিখিত অভিযোগে আরও বলা হয়, বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক দায়িত্ব গ্রহণের আগে তিতাসের সিস্টেম লস ছিল ৫ থেকে ৬ শতাংশ। বর্তমানে তা বেড়ে ৮ থেকে ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি শুধু বেসরকারি দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছে তিতাসের বকেয়া রয়েছে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি। এই বকেয়ার বিষয়ে উচ্চ আদালতের রিভিউ মামলায় তিতাসের পক্ষে রায় গেলেও এই অর্থ আদায়ে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না।
ওই অভিযোগপত্রে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রেও তিতাসের এমডির অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়েও উল্লেখ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ঘুষের বিনিময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জরিমানা মওকুফ, বিল বকেয়া থাকা সত্ত্বেও সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করা, সরকারি গাড়ির যথেচ্ছ ব্যবহার করাসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত তিতাস এমডি। জিসান নামে একজন ঠিকাদার তার এসব অপকর্মের অন্যতম সহযোগী বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।
গ্যাস সংকটের কারণে ২০১০ সাল থেকে দেশে আবাসিকে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে নানা রকম যাচাই-বাছাই ও বিবেচনা করে সীমিত পরিসরে শিল্পে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। শিল্পে গ্যাস সংযোগের জন্য দীর্ঘদিন ধরে কয়েকশ আবেদন জমা রয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও প্রতিবারই সেটি ব্যস্ত পাওয়া গেছে। পরে তার হোয়াটসঅ্যাপে কল করা হলে রিং হয়। কিন্তু তিনি তা ধরেননি। সর্বশেষ বিষয়বস্তু লিখে তাকে খুদেবার্তা পাঠানো হলেও সাড়া মেলেনি।
২০২১ সালে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান হারুনুর রশিদ। পরে দ্বিতীয় দফায় আরও এক বছরের জন্য নিয়োগ পান তিনি। সম্প্রতি আবারও তার মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়েছে।