সাত লাখ টাকা দিলেই স্বাধীনভাবে মাদক ব্যবসা করতে দেবেন রাজশাহীর চারঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুবুল আলম। শুধু তাই নয়, জেলা ডিবির দুই কর্মকর্তাকেও বদলির ব্যবস্থা করাবেন। থানা কম্পাউন্ডে নিজের বিশ্রামকক্ষে কারাগারে থাকা এক ‘মাদক ব্যবসায়ীর’ স্ত্রীর সঙ্গে আলাপের সময় এমন প্রস্তাব দেন তিনি। আলাপের অডিও ক্লিপ শনিবার ফাঁস হলে রাতেই তাকে পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়। ঘটনা তদন্তে রোববার তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছেন রাজশাহীর পুলিশ সুপার। কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তারা নিশ্চিত হয়েছেন ফাঁস হওয়া অডিও ক্লিপটি ওসি মাহবুবের।
এদিকে ওসির অডিও ক্লিপ ফাঁসের ঘটনায় রাজশাহী জেলা পুলিশে তোলপাড় চলছে। যে নারীর সঙ্গে ওসি এসব খোশ আলাপ জমিয়েছিলেন, সেই নারী শনিবার দুপুরে ওসি মাহবুব, ডিবির পরিদর্শক আতিকুর রেজা সরকারসহ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগে তিনি দাবি করেন, ডিবি পুলিশ তার স্বামীকে সাজানো মাদক মামলায় জড়িয়ে গ্রেফতার করেছে। অভিযোগ দিয়েই তিনি আত্মগোপনে আছেন।
জানা যায়, ১৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে ওসি থানা কম্পাউন্ডে নিজের শয়নকক্ষে সাহারা বেগম (২৮) নামের ওই নারীকে ডেকে নিয়ে ৭ লাখ টাকা দাবি করেন। সেখানে ওসির সঙ্গে সাহারার যে আলাপ হয়, তা রেকর্ড করা হয় গোপনে।
সাহারা বেগম রাজশাহীর চারঘাট থানার চামটা গ্রামের আব্দুল আলিম কালুর স্ত্রী। মাদক মামলায় গ্রেফতার হয়ে কালু কিছুদিন ধরে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। সাহারা বেগমের অভিযোগ, স্থানীয় প্রতিপক্ষের দ্বারা ম্যানেজ হয়ে জেলা ডিবির পরিদর্শক আতিকুর রেজার টিম তার স্বামীকে মাদক উদ্ধারের সাজানো মামলায় গ্রেফতার করে কিছুদিন আগে। ওই মামলার বিষয়ে কথা বলেতে তিনি ও তার ছেলে রাব্বী চারঘাট থানার ওসির কাছে যান।
অভিযোগে তিনি আরও বলেন, গত ইউপি নির্বাচনে চারঘাটের শলুয়া ইউপির ৩নং ওয়ার্ডের সদস্য পদে ভোট করেছিলেন তার স্বামী কালু। ওই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় একটি পক্ষের সঙ্গে কালুর বিরোধ হয়। এ কারণে প্রতিপক্ষ ডিবি পরিদর্শক আতিকুর রেজা সরকারকে ম্যানেজ করে তার স্বামীকে মাদকের সাজানো (ফিটিং) মামলায় গ্রেফতার করান।
এদিকে ফাঁস হওয়া ওই অডিও রেকর্ডে ওসি মাহবুবুল আলমকে বলতে শোনা যায়, ‘নির্বাচন করতে মন্ত্রী (পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী) আমাকে গাইবান্ধা থেকে চারঘাট থানায় নিয়ে এসেছেন। আমি তার কথা ছাড়া কারও কথা শুনি না।’ চারঘাট এলাকায় গিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের ধরে মামলা দেওয়ার কারণে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একজন পরিদর্শকের সমালোচনা করেন ওসি। তিনি বলেন, আমাকে দুই লাখ টাকা দেন, কালকেই ডিবির আতিককে বদলি করে দেব।’ এরপর সাহারা বেগমকে ওসি বলেন, ‘আপনার স্বামী আমার অনেক ক্ষতি করে জেলে গেছে (ওসির বিরুদ্ধে এসপি অফিসে অভিযোগ করেছিলেন কালু)। এবার আপনার পরিবারের কাউকে ধরলে ১০ লাখ টাকার কমে ছাড়াতে পারব না।’
ওসি আরও বলেন, ‘এখনো তোমার গায়ে আমি আঁচড় দেইনি। বহুত ফাঁকি দিয়েছ। কালকে ৫ লাখ টাকা নিয়ে আসবা। এখন সেরকম সময় নয় যে কেউ পয়সা খায় না। সবাই পয়সা খাচ্ছে। এমন কেউ বাদ নেই যে পয়সা খাচ্ছে না। থানা চালাতে আমার মাসে অনেক টাকা লাগে। আমি স্যারকে কথা দিয়ে এসেছি। স্যারকে বলেছি, এখানে মাদক ছাড়া টাকার আর কোনো উৎস নেই।’
ওসি আরও বলেন, ‘মুক্তার বিরুদ্ধে (চারঘাটের মাদকসম্রাট ও নারীর প্রতিপক্ষ) এখন অ্যাকশন নিতে পারব না, শুভর বিরুদ্ধেও (ছাত্রলীগ নেতা ও মাদক কারবারি) অ্যাকশন নিতে পারব না। তোমরা ৫ লাখ টাকা দিতে পারবা? ধরে ওদের চালান দিয়ে দেব। থাকি না থাকি, ওদের সাইজ করব আমি। তোমরা এলাকার বাইরে থেকে মাদক ব্যবসা করবে। কোনো সমস্যা নেই।’ জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক আতিকুর রেজা সরকার আতিকের সমালোচনা করে ওসি মাহবুবকে বলতে শোনা যায়, ‘নির্বাচনের আগে শুভকে ধরতে পারব না। সব কথা ভেঙে বলব না। কথা সব হয়ে গেল; যদি আতিকের বদলি চাও, আরও দুই লাখ টাকা দাও। কালকেই আতিকের বদলি হয়ে যাবে।’
ওসি মাহবুবুল আরও বলেন, ‘৫ লাখ আর ২ লাখ মিলে মোট ৭ লাখ টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করো। আতিক বাদ, ওই দুইজনকে (মুক্তা ও শুভ) ট্যাকেল দেওয়ার দায়িত্ব আমার। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরে মন্ত্রীকে বলে ওই দুইজনকে ধরে অ্যারেস্ট করে চালান করে দেব। আমার সব ওপরে লাইন। যে টাকা দিবা, এই টাকাই ওপরে কাজ করবে।’ এ সময় সাহারা বেগমের সুন্দর চেহারার প্রশংসা করেন ওসি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাহারা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ ও র্যাবের সোর্স হিসাবে কাজ করেন। তার মাধ্যমে চারঘাট এলাকায় অনেক মাদক উদ্ধার হয়েছে। গত ইউপি নির্বাচনে আমার স্বামী সদস্য পদে ভোট করেন। এরপর থেকে এলাকার মুক্তা, শুভ ও সাব্বিরের সঙ্গে বিরোধ বাধে। এর জেরে মিথ্যা মামলা দিয়ে আমার স্বামীকে গ্রেফতারর করায় তারা।’
তিনি আরও বলেন, ‘চারঘাটের চামটা গ্রামের মুক্তা, শিবপুর গ্রামের সাব্বির ও শলুয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ শুভ আমার কাছে ১ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। টাকা না দিলে মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেয়। সেই অভিযোগ করতে থানায় গেলে ওসি ৭ লাখ টাকা ঘুস দাবি করে আমাকে মাদকের ব্যবসা করতে বলেন।’ অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘আমার কাছেও অডিওটা এসেছে। কিন্তু কীভাবে হয়েছে আমি জানি না। এর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।’ রোববার দুপুরে ফোন দিলে তিনি জানান তাকে পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়েছে।