প্রাচীনকাল থেকেই সামাজিক ঐতিহ্যের কারণে বাংলাদেশের মেয়েরা অল্প বয়সেই সুচিশিল্পে পারদর্শী হয়ে উঠত। এই সুচি শিল্পে পারদর্শী হয়ে ওঠার পেছনে কোন পেশাদার প্রশিক্ষকের ভূমিকা বা অবদান ছিল না। দাদী, নানী, মা, খালাদের কাছ থেকে শিখে শিখেই আগেকার যুগের নারীরা সুচি শিল্পের অসাধারণ জ্ঞানার্জন করতেন, সুই-সুতার মিশ্রণে কাপড়-চটের মত সাধারণ জিনিসে তৎকালীন গ্রামবাংলার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক পরিবেশের যে নকশাদার চিত্র তারা মনের মাধুরী মিশিয়ে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতেন তা সত্যিই অসাধারণ। কখনও কখনও এদেশের নারী-শিশুকে সুই-সুতার মিশ্রণে কাপড় বা চটে নকশাদার প্রতিচিত্র অঙ্কন করে মানুষকে ইতিহাস সচেতন করে তুলেছেন। আবার কখনও কখনও নকশাদার প্রতিচিত্র অঙ্কন করে বর্ণিল বিচিত্র রংয়ের সমাবেশ ঘটিয়ে তৎকালীন গ্রামবাংলার সামগ্রিক জনজীবনের সুখ-দুঃখ তারা ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন কাপড় বা চটে। দক্ষ চিত্রশিল্পী যেমন ক্যানভাসে ছবি এঁকে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখে তেমনি বাংলার নারীরাও প্রাচীনকাল থেকে তাদের সুই-সুতায় বোনা কাপড় বা চটের অসাধারণ চিত্রকর্মকে দীর্ঘস্থায়ী করতে সুনির্দিষ্ট নকশাদার কাপড় বা চটকে বাঁধাই করে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখত যাকে ইংরেজিতে ওয়ালম্যাট বলা হয়। যুগের পরিবর্তনে মানুষের কর্মব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় এখন খুব কম মেয়েই দাদী-নানী, মা-খালাদের কাছ থেকে সুচিশিল্প বা ওয়ালম্যাট শেখার সময় পায়। আবার যৌথ পরিবার কমে একক পরিবার বেড়ে যাওয়ায় এখন অনেক মেয়ে ইচ্ছা থাকা সত্তে¡ও দাদী-নানী, মা-খালাদের কাছ থেকে ওয়ালম্যাট তৈরি শিখতে পারে না। অথচ ওয়ালম্যাটের চাহিদা পূর্বের তুলনায় দিনকে দিন বাড়ছে। ঘরের শোভা বাড়ানোর জন্য, ড্রইং রুমটাকে অতিথিদের কাছে আরো আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য গ্রাম-শহরের ঐতিহ্য-সচেতন, সৌন্দর্য-পিপাসু মানুষেরা দেয়ালে ওয়ালম্যাট ঝুলিয়ে ঘরের প্রতি অতিথিদের আকর্ষণ বাড়ানোর চেষ্টা করে। তাই অবসর সময়ে অলস সময় না কাটিয়ে অনেক গৃহিণী বা কম বয়স্ক মেয়েরা ভাল কোন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ওয়ালম্যাট তৈরির প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। এভাবে বাড়তি রোজগার করে পরিবারে সচ্ছলতা আনতে পারেন অনেকেই। যেসব নারী ক্ষুদ্র ব্যবসা করে সাবলম্বী হতে চান তারা ঘর গৃহস্থালীর কাজের পাশাপাশি ওয়ালম্যাটের ব্যবসা করে বাড়তি উপার্জন করতে পারেন।
যেসব উপকরণ লাগবে
ওয়ালম্যাট তৈরির জন্য কাপড়, সুই, সুতা, কালারফুল কাগজ, চট, গিøটার, ম্যাচের কাঠি, কটনবাট, টুথপিক, কাঠের ফ্রেম, ডিমের খোসা, কালার পেন্সিল, কাঠের গুঁড়ি, ধান, ড্রাই করা ফুল, পাতা ইত্যাদির মত উপকরণের দরকার হয়। এসব উপকরণের মধ্যে কিছু উপকরণ ওয়ালম্যাট তৈরিতে আদিকাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে অপরিহার্য উপকরণ হিসেবে। আবার কিছু উপকরণের বিকল্প রয়েছে। যুগের পরিবর্তনে ওয়ালম্যাট প্রস্তুতকারিণীর ইচ্ছা-রুচি-স্বাদ মতো বিকল্প ব্যবহার উপযোগী উপকরণ ব্যবহার করা যায়।
প্রশিক্ষণের সময় মেয়াদ
যারা সেলাইয়ে দক্ষ তারা এক থেকে দেড় মাসের মধ্যেই ওয়ালম্যাট তৈরি শিখতে পারবে, তবে যারা সেলাইয়ে তেমন দক্ষ নয় সেসব প্রশিক্ষণ ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের ওয়ালম্যাটের কাজ ভালভাবে শিখতে দুই থেকে তিন মাস সময় লাগতে পারে।
কোর্স ফি
ওয়ালম্যাট শিখতে হলে এককালীন কোর্স ফি হিসেবে প্রশিক্ষণার্থীদের ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা লাগবে। মাসিক ফি দেওয়া লাগবে না।
স্বাবলম্বী হতে হলে লক্ষ্যণীয় বিষয়
শুধুু শখের বশে নয় অনেক নারী বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ওয়ালম্যাট তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়ে কেউ কেউ ভবিষ্যতে বিভিন্ন শোপিসের দোকানে ওয়ালম্যাট সরবরাহের ব্যবসায় জড়িত হবেন; কেউ কেউ স্বল্প পুঁজির মাধ্যমে ওয়ালম্যাট বিক্রির জন্য শোরুম দিয়ে ব্যবসা করবেন আবার কেউ কেউ ভবিষ্যতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে স্বাবলম্বী হতে ইচ্ছুক নারীদের ওয়ালম্যাট তৈরির প্রশিক্ষণ দিবেন। এসব নারীর প্রতি কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকার ল²ীবাজারে অবস্থিত সম্পূর্ণা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদা কামাল মুক্তা। তিনি জানান, ‘ওয়ালম্যাট শিখে যেসব নারী ভবিষ্যতে স্বাবলম্বী হতে চান তাদের সবাইকে ভাল কোন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে মনোযোগী শিক্ষার্থীদের মত ভালভাবে মন দিয়ে এর উপর প্রশিক্ষণ নিতে হবে।’
এছাড়া একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে হলে আরো কিছু বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতে বলেছেন মাহমুদা কামাল। এ ক্ষেত্রে তিনি জানান, ‘ওয়ালম্যাট ব্যবসায় একজন সফল নারী উদ্যেক্তা হয়ে উঠতে হলে অবশ্যই সরবরাহকৃত ওয়ালম্যাট পণ্যের মানের দিকে কড়া নজর দিতে হবে। উন্নতমানের ওয়ালম্যাট পণ্য বিক্রির উদ্দেশ্যে বাজারজাত করলে এসব পণ্য খুব ভাল বিক্রি হবে। এসব ওয়ালম্যাটের ভাল দামও পাওয়া যাবে।
ওয়ালম্যাট ব্যবসায় মূলধন
অন্যান্য হস্তশিল্পের মত ওয়ালম্যাট ব্যবসার জন্যও মূধলন বা পুঁজির দরকার আছে। এক্ষেত্রে বাণিজ্যিকভাবে ওয়ালম্যাট ব্যবসার জন্য দশ থেকে পনের হাজার টাকার প্রয়োজন হবে। এ ক্ষেত্রে যেসব নারীর কাছে তেমন পুঁজিবা মূলধন নেই তারা বিভিন্ন ব্যাংকের এসএমই লোন নিয়ে ওয়ালম্যাট ব্যবসা শুরু করতে পারেন।
উৎপাদন খরচ যেমন পড়বে
অন্যান্য হস্তশিল্পের মত ওয়ালম্যাট তৈরির জন্য উৎপাদন খরচ লাগে, উপকরণ ব্যবহারের তারতম্যভেদে ওয়ালম্যাটের উৎপাদন খরচের মাত্রা ভিন্ন হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ওয়ালম্যাট প্রস্তুতকারিণীর ইচ্ছা, রুচি, পছন্দের উপরও ওয়ালম্যাট প্রস্তুতের উৎপাদন খরচ ভিন্ন হতে পারে, সাধারণত বাঁধানোসহ একটি ওয়ালম্যাট প্রস্তুতের উৎপাদন খরচ চারশ টাকা থেকে পাঁচশ টাকা পড়তে পারে।
ব্যবসা সম্প্রসারণের বাধা
বাংলাদেশে উন্নতমানের ওযালম্যাট পণ্য উৎপাদন এবং দেশী ক্রেতাদের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিদেশে ওয়ালম্যাট রপ্তানি করার মত যথেষ্ট দক্ষ নারী উদ্যোক্তা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সাহায্য, প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা, ব্যাংকের ঋণের সুদের হার হ্রাস করা সম্ভব হলে বিদেশেও ওয়ালম্যাট পণ্য রপ্তানি করে প্রচুর বৈদশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হত। যেসব ওয়ালম্যাট উৎপাদনের মূল কারিগর হিসেবে বাংলাদেশের নারীরা অবশ্যই দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনতেন।
এ প্রসঙ্গে সম্পূর্ণা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পরিচালক মাহমুদা কামাল জানান, “মূলধন সমস্যার কারণেই মানসম্মত পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি করা যাচ্ছে না। তাছাড়া সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অসহযোগিতা, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের হারের মত কারণে এ দেশে ওয়ালম্যাটের মত হস্তশিল্পের বিকাশ হচ্ছে না। এসব সমস্যার সমাধান হলে ওয়ালম্যাটের মত হস্তশিল্প বিকশিত হত।” এছাড়া যারা ব্যক্তিগতভাবে ওয়ালম্যাট হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তাদের সমস্যা প্রসঙ্গে মাহমুদা জানান, “ব্যক্তিগতভাবে আমাদের মত যারা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে বাংলাদেশের নারীদের স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ নিচ্ছি তাদের কমন কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। যে জায়গায় প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে সে জায়গার পরিসর ক্ষুদ্র থাকায় প্রশিক্ষণ নিতে আসা শিক্ষার্থীদের ঠিকমত প্রশিক্ষণ দেয়া যাচ্ছে না। শিক্ষার্থীরাও ঠিকমত ওয়ালম্যাটসহ অন্যান্য হস্তশিল্প প্রস্তুতের প্রশিক্ষণ নিতে পারছে না। অথচ ব্যাংকলোনের উচ্চ সুদহার করের বোঝার কারণে মুনাফার বদলে লোকসান দিতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি সহযোগিতা করে তবে প্রশিক্ষণ নিতে আসা শিক্ষার্থীদের কাছে হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ ব্যয়বহুল হবে না।’
যেসব জায়গায় ওয়ালম্যাট প্রশিক্ষণ দেয়া হয়
বাংলাদেশের সব জেলায় অবস্থিত বিসিকের কার্যালয়, খ্যাতনামা বেসরকারি এনজিও সংস্থার পরিচালিত হস্তশিল্প কেন্দ্রসমূহ থেকেও ওয়ালম্যাট প্রস্তুতের জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার নারীদের ওয়ালম্যাট তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, এছাড়া ঢাকায় অবস্থিত ব্যক্তিগত পরিচালনায় প্রতিষ্ঠিত সাকসেস হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, প্রতিবেশী হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, সালামী হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মির্জা এনজিও পরিচালিত হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মত সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে যে কোন প্রশিক্ষণ ইচ্ছুক নারী ওয়ালম্যাটের উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী হতে পারেন।