টানা দাবদাহে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। প্রচণ্ড গরমের সাধারণ ও কর্মজীবী মানুষের ভোগান্তি আর কষ্ট বেড়েছে। তবে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ। তীব্র রোদের কারণে দিনমজুর, রিকশাচালক ও ভ্যানচালকরা কাজ করতে পারছেন না। এদিকে কাজ না করলে খাবার জুটবে না। তাই পেটের তাড়নায় প্রচণ্ড দাবদাহ উপেক্ষা করে কাজে বেরিয়েছেন অনেকে। গরম উপেক্ষা করে বের হলেও অনেকেই হাঁসফাঁস করছেন।
মঙ্গলবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, তীব্র গরমে নাজেহাল অবস্থা প্রতিটি শ্রেণি-পেশার মানুষের। বিশেষ করে শ্রমজীবী ও কর্মজীবীদের জীবন যেন বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। তার পরও জীবন-জীবিকার তাগিদে ঘাম ঝরিয়ে ছুটতে হচ্ছে তাদের। কেউবা কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নিচ্ছেন ছায়ার নিচে। গরমের কারণে দীর্ঘসময় কাজ করতে না পারায় কমে গেছে তাদের আয়ের পরিমাণও। গরমের কারণে কষ্ট কয়েকগুণ বাড়লেও আয় বাড়েনি।
রাজধানীর কারওয়ানবাজারে কথা হয় রিকশাচালক হামিদ আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রায় ২০ বছর ধরে ঢাকায় রিকশা চালাই। এমন গরম আগে কখনো দেখি নাই। এটা তো ধনী-গরিবের জন্য আলাদা হয় না। তার পরও যাদের গাড়ি আছে, তারা এসির মধ্যে শান্তিতে থাকতে পারে, বাড়ি ও অফিসে ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে বসে থাকতে পারে। আর আমাদের মতো গরিবের এই গরমের মধ্যেই কষ্ট করে ভাত জোগাতে হয়। একদিকে গরমের কারণে বেশিক্ষণ রিকশা যেমন চালানো যায় না, আরেক দিকে যাত্রীও তেমন পাওয়া যায় না। মানুষ গরম ও রোজার কারণে দিনে বাসা থেকে তেমন বের হয় না।
রাজধানী নিউমার্কেট এলাকায় আরেক রিকশাচালক আতাহার মিয়া বলেন, এই গরমে রিকশা নিয়া রাস্তায় বের হওয়াই ভয়ের। বেশি দূরের ভাড়ায় যাই না। আধা ঘণ্টা রিকশা চালাই, আর আধা ঘণ্টা বিশ্রাম নেই। আবার অতিরিক্ত গরমের কারণে লোকজনও কম বের হচ্ছে। ফলে ভাড়াও বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। এতে তার আয় অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে তিনি জানান। ফলে ঈদের আগে কষ্ট বেশি হলেও আয় না থাকায় চলতে কষ্ট হচ্ছে।
ভ্যানচালক আনিছ হোসেন বলেন, খুব সকালে বাড়ি থেকে বের হয়েছি। গরমে ভ্যানগাড়ি চালানো খুবই কষ্টের। তাই দুপুর হলেই বাড়িতে চলে যাই।
একই কথা বলেন রাইড শেয়ারিংয়ে যাত্রী বহনকারী মোটরসাইকেলের চালক মো. রাশেদ মিয়ার। তিনি বলেন, এই রোদে মোটরসাইকেল চালাতে কষ্ট হয়। তার ওপর দীর্ঘক্ষণ জ্যামে বসে থাকতে হয়। কিন্তু জীবিকার তাগিদে প্রতিদিনই বের হতে হয়। এতেও তেমন লাভ হচ্ছে না। রোদ আর গরমের কারণে এখন মানুষ মোটরসাইকেলে যেতে চায় না। কষ্ট করে হলেও বাস বা রিকশায় যায়। কারণ বাস ও রিকশায় অন্তত মাথার ওপর ছায়া দেয়ার মতো কিছু আছে, ফ্যান আছে। মোটরসাইকেলে গেলে রোদে পুড়তে হয়।
হাতিরপুল মোড়ে সবজি বিক্রেতা কাওসার বলেন, কারওয়ানবাজার থেকে আড়ত থেকে সবজি কিনে ভ্যানগাড়ি নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করি। কিন্তু কয়েকদিন থেকে গরমে অবস্থা খুব খারাপ। সারাদিন রোদে ঘুরলেও তেমন একটা বিক্রি হয় না। গরমে খুবই কষ্ট লাগে। কিন্তু সংসারের কথা চিন্তা করে বের হতে হয়।
এদিকে প্রচণ্ড গরমে যাদের আয় কমে যাচ্ছে, তাদের সরকারি সহায়তা দেয়া উচিত বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, তাপদাহ হয়তো আরও কয়েকদিন চলবে। কিন্তু শুধু তাপদাহ নয়, ঝড় বৃষ্টি বন্যা সব কিছুতেই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করা মানুষদের সমস্যা হয়। তাই শুধু তাপদাহ হচ্ছে এই বিবেচনা থেকে চিন্তা না করে, আমাদের দেখতে হবে বৃহত্তর পরিসরে।
সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে শ্রমজীবী মানুষকে যুক্ত করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এরকম সময়ে যাদের রুটি-রুজির সমস্যা হচ্ছে, তাদের সহায়তা দেয়ার কথা চিন্তা করা যেতে পারে। সরকারের বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি আছে। এতে কীভাবে দিন আনে দিন খায় মানুষদের যুক্ত করা যেতে পারে সেদিকে নজর দিতে হবে।
অন্যদিকে তাপদাহের ফলে শ্রমজীবী মানুষজনই সবচেয়ে বেশি ডায়ারিয়া, কলেরা ও জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানান জনস্বাস্থ্য বিশারদ ডা. লেলিন চৌধুরী।
সুপেয় ও নিরাপদ পানির অভাবে এসব রোগ হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, শ্রমজীবী মানুষ যারা উন্মুক্ত জায়গায় কাজ করছে, তারা তো সুপেয় ও নিরাপদ পানি পান না। ফলে তারা বাধ্য হয়ে রাস্তার পাশে অনিরাপদ পানি বা শরবত পান করছেন। এতে নানান রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা।
শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক এবং স্বাস্থ্যগত দিক সরকারের বিশেষ বিবেচনায় নেয়ার পরামর্শ রেখে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে রাস্তার মোড়ে মোড়ে সুপেয় পানি পান করার ব্যবস্থা করা উচিত। প্যাকেট করা যাবে এরকম স্বাস্থ্যকর খাবার তৈরি করে একবেলা হলেও শ্রমজীবী মানুষের জন্য সরবরাহ করা উচিত। একইসঙ্গে জনবহুল এলাকাগুলোতে প্রাথমিক চিকিৎসার সুব্যবস্থা করা উচিত। কেউ অসুস্থ বোধ করলে সঙ্গে সঙ্গে যাতে চিকিৎসা নিতে পারেন।