জালিয়াতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত সিলেটের বিতর্কিত শিল্পপতি, সদ্য জামিনে কারামুক্ত রাগীব আলীর মালিকানায় ও তার ছেলে আবদুল হাইয়ের সম্পাদনায় অবৈধভাবে প্রকাশিত হচ্ছে দৈনিক সিলেটের ডাক পত্রিকা। গত ২৯ নভেম্বর উচ্চ আদালতের আইনজীবীর প্রত্যয়নপত্র ফ্যাক্সযোগে পাঠিয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে কোনো ধরণের ঘোষণাপত্র ছাড়াই ৩০ নভেম্বর থেকে বের করা হচ্ছে পত্রিকাটি। সিলেটের ডাক পত্রিকার প্রকাশক রাগীব আলী ফৌজদারি মামলায় আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন ডিক্লারেশন অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট ১৯৭৩ এর সেকশন ২০ অনুযায়ী গত ১৮ জুন সিলেটের জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার দৈনিক সিলেটের ডাক-এর ডিক্লারেশন বাতিল করেন। এর পর বন্ধ থাকে প্রকাশনা। জস্ব প্রতিবেদক।। জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে নেয়া হয়নি কোনো ধরণের ঘোষণাপত্র!
সিলেটের ডাক পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল সংক্রান্ত জেলা প্রশাসকের আদেশের স্থগিতাদেশ চেয়ে রাগীব আলী হাই কোর্টে একটি রিট পিটিশন করেন। গত ২৯ নভেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর এবং আতাউর রহমান খান সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ দৈনিক সিলেটের ডাক পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিলের আদেশ তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন।
উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের বিষয়ে একজন আইনজীবীর প্রত্যয়নপত্র জেলা প্রশাসকের কাছে ফ্যাক্সযোগে পাঠিয়ে গত ৩০ নভেম্বর থেকে নগরীর কাষ্টঘরের একটি নামবিহীন প্রেসে ১৬৪ দিন পর সিলেটের ডাক পত্রিকা ছাপানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে কোনো ধরণের ঘোষণাপত্র নেওয়াও হয়নি। ১৯৭৩ সালের ছাপাখানা আইনে টানা তিন মাসের বেশি কোনো দৈনিক পত্রিকা বন্ধ থাকলে জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে পুনরায় ঘোষণাপত্র নেওয়ার বিধানও মানেননি সিলেটের ডাক কর্তৃপক্ষ। ১৯৭৩ সালের প্রকাশনা ও ছাপাখানা আইনের ৯(৩) ধারায় উল্লেখ রয়েছে, ‘যে ক্ষেত্রে সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছিল, সেই ক্ষেত্রে উহা প্রকাশিত না হইলে (ক) দৈনিক সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে ৩ মাস; এবং (খ) অন্য যেকোনো সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে ৬ মাস যাবৎ প্রকাশিত না হইলে উক্ত সংবাদপত্রের বিষয়ে প্রদত্ত ঘোষণা বাতিল হইয়া যাইবে এবং উক্ত সংবাদপত্র পরবর্তী মুদ্রণ বা প্রকাশ করিবার পূর্বে মুদ্রাকরকে এবং প্রকাশককে ধারা ৭-এর অধিন নতুন করিয়া স্বাক্ষর এবং ঘোষণা প্রদান করিতে হইবে।
ধারা-৩২ : ‘কোনো ব্যক্তি এই আইনের বিধান লঙ্ঘনপূর্বক কোনো সংবাদপত্র সম্পাদন, মুদ্রণ বা প্রকাশ করিলে অথবা এই আইনের বিধান প্রতিপালন হয় নাই জানাসত্বেও কোনো সংবাদপত্র সম্পাদন, মুদ্রণ বা প্রকাশ করিলে বা করাইলে তিনি অনধিক ৫০০০ টাকা অর্থদন্ড বা অনুর্ধ্ব ৬ মাসের কারাদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবে।’
এ অবস্থায় দৈনিক সিলেটের ডাক কর্তৃপক্ষকে জেলা প্রশাসক বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর নিকট থেকে পুনরায় ঘোষণাপত্র বা ডিক্লারেশন নিয়ে পত্রিকা প্রকাশ করতে হবে। ১৬৪ দিন বন্ধ থাকার পর জেলা প্রশাসকের অনুমোদন না নিয়ে এ ধরণের প্রকাশনা সম্পূর্ণ বেআইনী ও অবৈধ। তাছাড়া উচ্চ আদালতের আদেশের অনুকূলে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর পাঠানো একটি ফ্যাক্স কপি গ্রহণের মাধ্যমে কি ভাবে জেলা প্রশাসক যাচাই বাছাই ছাড়া তাৎক্ষনিকভাবে নিশ্চিত হলেন তাও প্রশ্নসাপেক্ষ।
এছাড়া সিলেটের ডাক পত্রিকার প্রিন্টার্স লাইনে রাবেয়া অফসেট প্রিন্টার্স এর কথা উল্লেখ থাকলেও মধুবন মার্কেটে এ নামে কোনো ছাপাখানার অস্তিত্ব নেই। জানা গেছে, কাষ্টঘরের একটি নাম ও অনুমোদনবিহীন (জেলা প্রশাসকের ঘোষণাপত্র বা ডিক্লারেশন) ছাপাখানা থেকে সিলেটের ডাক পত্রিকা ছাপানো, প্রকাশ ও প্রচার করা হচ্ছে। যা একই আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
১৯৭৩ সালের ছাপাখানা ও প্রকাশনা আইনের ৪ ধারায়উল্লেখ আছে, ‘১। কোন ব্যক্তি পুস্তক বা কাগজ ছাপাবার জন্য তাহার দখলে কোন ছাপাখানা রাখিতে পারিবেন না, যদি না তিনি উক্ত ছাপাখানাটি যে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের স্থানীয় অধিক্ষেত্রের মধ্যে অবস্থিত, সেই জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের সম্মুখে ফরম-ক তে ঘোষণা প্রদান এবং উহাতে স্বাক্ষর প্রদান না করেন। ২। যতবারই কোন ছাপাখানার পরিবর্তন ঘটিবে, ততবারই নতুন করে ঘোষণা প্রদানের প্রয়োজন হইবে।
ধারা-৩০ এ উল্লেখ করা হয়েছে, ঘোষণাপত্র প্রদান ব্যতিরেকে কোন ব্যক্তি অবৈধভাবে ছাপাখানা পরিচালনা করিলে ধারা ৪ এর বিধান অনুযায়ী তিনি অনধিক ৫০০০ টাকা অর্থদন্ড অথবা অনুর্ধ্ব ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন।’
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, সিলেটের ডাক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন রাগীব আলীর ছেলে আবদুল হাই। দেবোত্তর সম্পত্তির তারাপুর চা-বাগান দখলের মামলায় পলাতক থাকা অবস্থায় আবদুল হাইয়ের বদলে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব নেন জনৈক আবদুল হান্নান। পরে মামলার রায়ে সাজাপ্রাপ্ত হলেও রাগীব আলীর নাম পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি হিসেবে রেখে পত্রিকার প্রকাশনা অব্যাহত রাখা হয়। এ ব্যাপারে একাধিক নোটিশ জারি করার পর পত্রিকা ডিক্লারেশন বাতিল ঘোষণা করা হয়।
সিলেট নগরীর পাঠানটুলায় দেবোত্তর সম্পত্তি তারাপুর চা-বাগানে ভুয়া সেবায়েত সেজে ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক (চিঠি) জাল করে দখল করা হয়। ১৯৯৯ সালের ২৫ আগস্ট ভূমি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তারাপুর চা-বাগান পুনরুদ্ধারের সিদ্ধান্ত হলে ২০০৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) এস এম আবদুল কাদের বাদী হয়ে দখলদার রাগীব আলী, তার ছেলে আবদুল হাইসহ পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের রায়ে মামলা দুটি পুনরুজ্জীবিত করে বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর নির্দেশ দেওয়া হয়। বিচারিক আদালতে রাগীব আলী ও তার ছেলে আবদুল হাই দন্ডপ্রাপ্ত হন।